চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের শুরুতেই আগুন নিয়ন্ত্রণে ঝাঁপিয়ে পড়েন কুমিরা ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা। ঘটনাস্থল থেকে ফায়ার সার্ভিসকে বলা হয়েছিল, কন্টেইনার ডিপোতে আগুন লেগেছে। সেখানে রয়েছে গার্মেন্টস পণ্য।
এমন তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন ফায়ার ফাইটাররা। পরবর্তীতে সেখানে কেমিক্যালের বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় মালিকপক্ষের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আগুন লাগার ১২ ঘণ্টা পরও কোন কনটেইনারে কী আছে, সে সম্পর্কে ধারণা ছিল না তাদের।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, কেমিক্যালসহ রাসায়নিক বিস্ফোরণের মতো ঘটনা মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিসের প্রশিক্ষিত একটি বিশেষ হ্যাজমাট (বিপজ্জনক উপাদান) টিম রয়েছে। এ টিমের সদস্য সংখ্যা ১০০ থেকে ১৫০ জন। সঠিক তথ্য না পাওয়ায় ওই টিমের সদস্যদের পাঠায়নি ফায়ার সার্ভিস। ফলাফল হিসেবে বাহিনীর ১২ সদস্যকে হারাতে হয়েছে। নয়জনের মরদেহ মিললেও এখনও নিখোঁজ তিনজন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন ১৫ ফায়ার ফাইটার।
ঘটনার শুরুতে জানা যায় সেখানে গার্মেন্টস পণ্য রয়েছে। সেই হিসেবে আমাদের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে যান। কিন্তু আমরা জানতামই না সেখানে কেমিক্যাল রয়েছে। এটা না জানায় আমাদের লোকজন স্বাভাবিক আগুন নিয়ন্ত্রণের মতো ডিপোর ভেতরে প্রবেশ করে। তখনই একে একে কেমিক্যালভর্তি কনটেইনারগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে জানান, ফায়ার সার্ভিসের ফার্স্ট রেসপন্স টিমের সদস্যরা জানতেন ডিপোর কনটেইনারে ছিল গার্মেন্টস পণ্য। কিন্তু কাজ শুরুর ২০ মিনিট পর একে একে বিস্ফোরণে দিশেহারা হয়ে পড়েন ফায়ার ফাইটাররা। তারা বুঝে উঠতে পারছিলেন না ভেতরে কী হচ্ছে?
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার শুরুতে জানা যায় সেখানে গার্মেন্টস পণ্য রয়েছে। সেই হিসেবে আমাদের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে যান। কিন্তু আমরা জানতামই না সেখানে কেমিক্যাল রয়েছে। এটা না জানায় আমাদের লোকজন স্বাভাবিক আগুন নিয়ন্ত্রণের মতো ডিপোর ভেতরে প্রবেশ করে। তখনই একে একে কেমিক্যালভর্তি কনটেইনারগুলো বিস্ফোরিত হতে থাকে। ফলে ইতিহাসের সর্বোচ্চ আত্মাহুতি দিতে হয় আমাদের শুধুমাত্র ভুল তথ্যের কারণে।
‘আগুন লাগার ১০-১২ ঘণ্টা পার হওয়ার পরও মালিকপক্ষ আমাদের জানায়নি ডিপোর ভেতরে কী মজুত আছে। কেমিক্যাল বিস্ফোরণে সৃষ্ট আগুনের ঘটনা কিন্তু অন্য সব আগুনের মতো প্রতিনিয়ত ঘটে না। মাঝে মধ্যে ঘটে। তবে এসব ঘটনা মোকাবিলার জন্য আমাদের ব্যাপক প্রস্তুতি রয়েছে। উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতির কোনো অভাব নেই ফায়ার সার্ভিসের। এছাড়া আমাদের প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ সদস্য রয়েছেন, যারা বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন।’
ফায়ার সার্ভিসের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আত্মাহুতি
ফায়ার সার্ভিস বলছে, সীতাকুণ্ডের দুর্ঘটনায় একসঙ্গে এত সংখ্যক ফায়ার ফাইটারের আত্মাহুতি বাহিনীর প্রতিষ্ঠার পর আর দিতে হয়নি।
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৮২ সালে তৎকালীন ফায়ার সার্ভিস পরিদপ্তর, সিভিল ডিফেন্স পরিদপ্তর এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের উদ্ধার পরিদপ্তর সমন্বয়ে বর্তমান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিহত হন ১৭ ফায়ার সার্ভিসের কর্মী। সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রাণ হারান ফায়ার সার্ভিসের সদস্য মো. রানা মিয়া, মনিরুজ্জামান, আলাউদ্দিন, মো. ইমরান হোসেন মজুমদার (বাঁ থেকে, উপরে), মো. শাকিল তরফদার, মিঠু দেওয়ান, রমজানুল ইসলাম, নিপন চাকমা ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (বাঁ থেকে, নিচে) । ছবি- ফায়ার সার্ভিস ১৯৮৯ সালে মো. মাহবুবুর নামের এক ফায়ারম্যান, ১৯৯১ সালে মো. মুসলিম উদ্দিন, ২০০১ সালে মো. জহিরুল হামিদ ও মো. মাহাবুবুর হোসেন খান, ২০০৬ সালে আক্তার হোসেন, ২০০৮ সালে অমল চন্দ্র মণ্ডল, ফায়ার লিডার আব্দুর রশিদ ও ফায়ার সার্ভিসের ড্রাইভার আজিজ হাওলাদার নিহত হন। ২০০৯ সালে শেখ জালাল, ২০১৫ সালে ফায়ারম্যান মো. শাহ আলম, ২০১৩ সালে আবু সাইদ, ২০১৭ সালে আব্দুল মতিন, ২০১৯ সালে মো. সোহেল রানা, ২০২১ সালে ডুবুরি আব্দুল মতিন এবং ২০২১ সালে মো. মিলন মিয়া নিহত হন। ফায়ারম্যান নির্গেন্দু প্রসন্ন সিংহ ও আবুল কালাম আজাদও নিহত হন অগ্নিনির্বাপণ করতে গিয়ে।
এক সীতাকুণ্ডের ঘটনায় সর্বোচ্চ নয়জন নিহত এবং তিনজন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। নিহত ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা হলেন- মো. রানা মিয়া, মনিরুজ্জামান, আলাউদ্দিন, মো. শাকিল তরফদার, মিঠু দেওয়ান, রমজানুল ইসলাম, নিপন চাকমা, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও মো. ইমরান হোসেন মজুমদার। নিখোঁজ তিন সদস্য হলেন- শফিউল ইসলাম, রবিউল ইসলাম ও ফরিদুজ্জামান।
সীতাকুণ্ডে এত বড় আত্মত্যাগের কারণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের মধ্যেও হতাশা দেখা দিয়েছে। সাধারণ ফায়ার ফাইটারদের মুখে মুখে এখন একটাই প্রশ্ন, ভুল তথ্যের কারণে কেন তাদের আত্মাহুতি দিতে হলো? সীতাকুণ্ডের আগুন নিয়ন্ত্রণের সময় নিখোঁজ হন ফায়ার সার্ভিসের সদস্য শফিউল ইসলাম, রবিউল ইসলাম ও ফরিদুজ্জামান । ছবি- ফায়ার সার্ভিস গত সোমবার (৬ জুন) সকালে রাজধানীর ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তর এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন আহত ফায়ার ফাইটারদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন এ প্রতিবেদক। স্বাভাবিক কাজের পাশাপাশি তাদের মুখে এখন শুধু সীতাকুণ্ডের আত্মাহুতির গল্প।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্নে চিকিৎসাধীন আহত এক ফায়ার ফাইটারের স্বজন জানান, প্রথমে ডিপোর ভেতরে গার্মেন্টস পণ্যে আগুন লাগার খবর পান তারা। স্পটে পৌঁছে দ্রুত পানির পাইপ নিয়ে ডিপোর ভেতরে প্রবেশ করেন। ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে তারা পানি ছিটাতে থাকেন। হঠাৎ কনটেইনারগুলো একে একে বিস্ফোরিত হতে থাকে। প্রথম বিস্ফোরণেই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ফায়ারের কর্মীরা। পরে চোখ খুলে চট্টগ্রাম সিএমএইচে নিজেদের দেখেন তারা।
এদিকে, উদ্ধার হওয়া ফায়ার ফাইটারদের মরদেহগুলো কেমিক্যাল বিস্ফোরণে সৃষ্ট গ্যাসের কারণে অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যেতে দেখা যায়।
মালিক পক্ষকে অবশ্যই এই তথ্য জানাতে হবে যে, তার এরিয়াতে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু আছে কি না। কারণ, ফায়ার ফাইটারদের অবশ্যই বিষয়টি জানতে হবে। থাকলে সেই অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান
ভুল তথ্যে অগ্নিনির্বাপণ করতে গিয়ে ফায়ার ফাইটারদের মৃত্যুর ফাঁদে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে এলাকায় ফায়ার ফাইটাররা আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে যান সেই এলাকার একটা ঝুঁকিপূর্ণ ম্যাপ তাদের কাছে থাকা দরকার। কারখানার মালিক-কর্তৃপক্ষের কাছে এসব তথ্য থাকে। তাদের ফায়ার ফাইটারদের জানানো উচিত যে, তাদের এরিয়ায় কোথাও কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কিছু আছে কি না। সীতাকুণ্ডের ঘটনায় গুরুত্বপূর্ণ এসব তথ্য আদান-প্রদানে সমন্বয়হীনতা ছিল বোধ হয়। এই কারণে এমন বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে।
‘মালিক পক্ষকে অবশ্যই এই তথ্য জানাতে হবে যে, তার এরিয়াতে ঝুঁকিপূর্ণ কিছু আছে কি না। কারণ, ফায়ার ফাইটারদের অবশ্যই বিষয়টি জানতে হবে। থাকলে সেই অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।’
কেমিক্যাল বিস্ফোরণে সৃষ্ট আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের বিশেষায়িত যে টিম রয়েছে তা পর্যাপ্ত কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, পর্যাপ্ত নয়। তাদের আরও উন্নত মানের ইকুইপমেন্ট ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। তারা ইন্ডিভিজুয়াল প্রশিক্ষণ নিয়েছে কিন্তু এ ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিশেষায়িত একটি ইউনিট দরকার ফায়ার সার্ভিসের। এছাড়া তাদের বিভিন্ন সময় মহড়া দিয়ে এই ধরনের বড় দুর্ঘটনার জন্য প্রস্তুত করে রাখতে হবে।’
গত শনিবার (৪ জুন) রাত সাড়ে ৯টার দিকে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ওই দুর্ঘটনায় ৪৪ জন নিহত ও দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেলসহ আশপাশের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিস্ফোরণে নিহত অনেকের মরদেহ পুড়ে অঙ্গার হওয়ায় সবার পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। তাই পরিচয় শনাক্তে স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু হয়েছে। সোমবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ইমারজেন্সি কেয়ারের সামনে নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা নমুনা দেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
test 2 ...
test ...
hi thi is test ...