লাল টুলের উপর পান-সিগারেটের ট্রে। পরনে একটি গামছা আর শার্টের উপর স্লিভলেস কোট। বসে আছেন হুইল চেয়ারে। শেরপুরের বাসিন্দা মো. সেলিম মিয়া (৩৮)। বাবা মো. আব্দুস সালাম। কৃষি কাজের পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ৫ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি পঞ্চম। স্থানীয় ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসা থেকে ২০০৪ সালে এইচএসসি পাস করেন। ছোট ভাইয়ের সঙ্গে ২০০৬ সালে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য চলে আসেন ঢাকায়। তারপর একটি কলেজে স্নাতকে ভর্তি হোন। লেখাপড়ার পাশাপাশি টঙ্গীর গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ব্লেস লিমিটেডে কিউসি ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। যা আয় হতো তাতে করেই নিজের খরচ মিটিয়ে বাড়িতেও টাকা পাঠাতে পারতেন। এভাবেই চলছিল দিন
। জরুরি কাজে ছুটি নিয়ে একবার বাড়িতে যান। ২০১১ সালের ২৭শে জানুয়ারি। ভয়ঙ্কর সেই কালো দিনটিতে একটি মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন বাড়ির পাশের একটি বাজারে। যাওয়ার পথে একটি ব্রিজের উপর উঠতেই ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তছনছ হয়ে যায় জীবনের সব স্বপ্ন। ভর্তি করা হয় শেরপুরের স্থানীয় একটি হাসপাতালে। ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত করে জানান, তার মেরুদণ্ডের হাড় ও দুই পায়ে মারাত্মক সমস্যা ধরা পড়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য জরুরিভিত্তিতে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তাররা অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক সপ্তাহ পরে অপারেশন করে ডাক্তাররা জানান, মো. সেলিম মিয়ার পা আর কখনই ভালো হবে না। রক্ত আর ক্যালসিয়াম চলাচল বন্ধ হওয়াতে তিনি আর দুই পা নাড়াচাড়া করতে পারবেন না। এবং মেরুদণ্ডের হাড়ও ভেঙে গেছে। শুধু কোমর ও হাত নাড়াচাড়া করতে পারেন। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে চলে যান বাড়িতে। কয়েক মাস বাড়িতে থাকার পর আর ভালো লাগে না। কাজপাগল মানুষ তিনি। কাজকর্ম না করে থাকতে পারবেন না। অনেকবার বলার পরও পরিবারের কাউকে রাজি করাতে পারেননি। সবার বক্তব্য একই। যেখানে হাঁটা-চলার উপায় নেই। হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয় সেখানে কাজ করার তো চিন্তাই আসে না। সবাই মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি এতটা দুর্বল হননি। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সেলিম অনেকটা অবাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়েন। বাড়ির পাশে কড়ুয়া বাজার থেকে সরাসরি ঢাকার বাস পাওয়া যায়। বাসে উঠে চলে আসেন ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনালে। একদিকে যেমন হাঁটা-চলা করতে পারেন না। অন্যদিকে পকেটে নাই টাকা। থাকা-খাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রথমদিন রাত কাটান বাস টার্মিনালের বারান্দায়। পরের দিন থেকে শুরু হয় নতুন করে জীবনযুদ্ধ। পরিচিত হতে থাকেন আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে। তুলে ধরেন নিজের জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। পরামর্শ চান সবার কাছে কি করবেন। থেমে থাকতে চান না তিনি। কিছু একটা করতে চান। মহাখালী বাস টার্মিনালে সেলিমের পান-সিগারেটের দোকানে মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি। সেলিম বলেন- আমি হামাগুড়ি দিয়ে মানুষের কাছে যাই। নিজের আন্তরিক ব্যবহার দিয়ে আমি খুব সহজেই সবার মন জয় করেছি। তারপর মো. শামিম নামের একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তখনই আমার মনে অনেক সাহস জন্মায়। তিনি আমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো ভাবেন। ওনার পরামর্শেই আমি পান-সিগারেটের দোকান দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। তিনি আমাকে ব্যবসার জন্য ৪ হাজার টাকা ও একটি হুইল চেয়ার কিনে দেন। তারপর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মহাখালী বাস টার্মিনাল আমার ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব কিছু। এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন। ২০১৫ সালে স্বামী পরিত্যক্ত মোসাম্মৎ কোহিনুর বেগমের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তিনি ১ মেয়ে ও এক ছেলের জননী। আমার মতো তিনিও মহাখালী বাস টার্মিনালে থাকতেন। কিছুদিন দুজন দুজনকে জানাশোনার পর এক বছর আগে আমরা বিয়ে করি। সেলিম বলেন- জীবনে অনেক স্বপ্ন ছিল। কোনোটাই বাস্তবায়ন করতে পারি নাই। দুর্ঘটনা আমার জীবনটাকে অনেক পেছনে নিয়ে গেল। আজ পর্যন্ত যদি চাকরিটা করতে পারতাম তবে এখন আমি অনেক ভালো অবস্থানে থাকতাম। কিন্তু আমি দুঃখ করি না। কারণ আমার মনে এখনো অনেক সাহস আছে। আমি হয়তো আর কোনোদিন হাঁটা-চলার কোনো কাজ করতে পারবো না। তারপরেও স্বপ্ন আছে আস্তে আস্তে পুঁজি জমা করে বড় কোনো ব্যবসা করবো। ছেলেকে মাদরাসায় ভর্তি করেছি। মেয়েকে আগামী বছর ভর্তি করবো। তিনি বলেন, আমি সেই ছোটবেলা থেকেই নিয়ম করে খবরের কাগজ পড়তাম। এখনো পড়ি। মানুষের ইচ্ছা শক্তি থাকলে তার পক্ষে সব সম্ভব। আমি যদি তখন সাহস করে বাড়ি থেকে বের না হতাম তাহলে আমার জীবনটা অন্ধকারে ডুবে যেত। আমি আমার মনের সাহস আর আত্মবিশ্বাস দিয়ে এতদূর এসেছি। আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে আমার তো এত বয়স হয়নি। এখনো আমার পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব। শুধু শুধু আমি অন্যের বোঝা হয়ে থাকবো কেন। এখন অনেক মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয়। তারা সবাই আমাকে অনেক সাহায্য করে। যেকোনো বিপদে আপদে তারা আমাকে অনেক সাহায্য করে। এখন আমার মনেই হয় না আমার জীবনে কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছিল। প্রতিদিন দোকানে বসলে চার থেকে পাঁচ শ’ টাকা আয় হয়। তাতে করেই ভালোভাবে চলতে পারছি। আমি হাঁটা-চলা করতে না পারলেও দেশের সব খবর রাখি।