অমর একুশে গ্রন্থমেলার তৃতীয় দিন ছিল শিশু প্রহর। এ উপলক্ষে মেলার দ্বার খোলে সকাল ১১টায়। অভিভাবকদের হাত ধরে মেলায় আসে শিশুরা। পছন্দের বই কেনে। সিসিমপুরের টুকটুকি, হালুম, শিপু, ইকরিদের নিয়ে মেতে উঠে। বেলা ১টা পর্যন্ত তাদের কোলাহলে মুখর ছিল মেলা প্রাঙ্গণ। মাসব্যাপী মেলার প্রতি শুক্র ও শনিবার থাকবে শিশু প্রহর। গতকাল সকালে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, শিশুদের ছোটাছুটি, হৈ-হুল্লোড়। পছন্দের বই কেনার জন্য আবদার। অভিভাবকরাও বাচ্চাদের পছন্দকে অগ্রাধিকার দিয়ে বই কিনে দেন। শিশুদের এমন কোলাহলে জমে উঠে মেলা। বিক্রিও ভালো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশকরা। শিশুপ্রহরের কারণে এদিন শিশুদের নতুন বই প্রকাশ করেন তারা।
‘আমি অনেক গল্প জানি। বাঘ মামা আর শেয়ালের গল্প পড়ি। ভূতের গল্প পড়ি।’ বড় ভাইয়ের সঙ্গে মেলায় আসা প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী রাজুকে কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করলে এভাবেই নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে সে। বরাবরের মতো এবারও মেলায় শিশুদের বিশেষ আকর্ষণ ছিল সিসিমপুরের স্টল। স্টলের পাশে ছোট একটা মঞ্চে সিসিমপুরের রঙিন পর্দার চরিত্রগুলো (টুকটুকি, হালুম, ইকরি, শিপু) শিশুদের সামনে হাজির হয়। পছন্দের চরিত্রগুলোকে কাছে পেয়ে শিশুদের যেন আনন্দ ধরছিল না। চরিত্রগুলোর সঙ্গে নেচে গেয়ে বেশ ভালো সময় কাটে শিশুদের। ব্যাংক কর্মকর্তা শফিউল ইসলাম তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে স্বর্ণাকে নিয়ে এসেছিলেন মেলায়। সিসিমপুরের মঞ্চে উঠে আর নামতেই চাচ্ছিল না স্বর্ণা। দুয়েকবার নামাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বাবাও হাসিমুখে মেয়ের উচ্ছ্বলতা দেখছেন। জানতে চাইলে বলেন, ছুটির দিন ছাড়া কখনো ঘুরতে বের হওয়া যায় না। তাই মেয়েকে নিয়ে মেলায় আসি। শিশুদের বই কেনায় যাতে সুবিধা হয় সে জন্য মেলার উদ্যানের অংশে শিশু চত্বর নামে একটি কর্নার রাখা হয়। কিছু কিছু স্টলে বাচ্চাদের আকৃষ্ট করতে ডিজিটাল বোর্ড বসিয়ে জনপ্রিয় কার্টুন চালানো হচ্ছে। শিশু প্রহরে মেলা কেমন জমেছে জানতে চাইলে সপ্তডিঙা প্রকাশনের আবু হাসনাত বলেন, বিক্রি ভালো হচ্ছে। বাণিজ্য মেলা ও এসএসসি পরীক্ষার কারণে অনেকে এদিকে আসেনি। আশা করি সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে লোক সমাগম বাড়বে, বিক্রি বাড়বে। প্রিয় প্রকাশের কামরুল হাসান টিটু বলেন, মেলায় শুরুতে বিক্রি একটু কম হয়। কিন্তু এবার শুরুতেই শিশু প্রহর জমে উঠেছে। বাচ্চারা দল বেঁধে আসছে। বই কিনছে। ভালো লাগছে। প্রথম শিশু প্রহরে শিশুদের জন্য ৬২টি নতুন বই এনেছেন প্রকাশকরা। এর মধ্যে শিশুরাজ্য থেকে প্রকাশিত আহসান হাবীবের কমিকস ‘ভয়ঙ্কর পোকা’, শিশু প্রকাশ থেকে ইমদাদুল হক মিলনের ‘ছোটদের নানারকম গল্প’, পঙ্খিরাজ প্রকাশনী থেকে মাহমুদ বিক্রমের ‘ঝুমঝুমি টুমটুমি’ অন্যতম। এদিকে শিশু প্রহর শেষ হওয়ার পর বিকাল ৩টা থেকে প্রতিদিনের মতো মেলা শুরু হয়। চলে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।
মেলার তৃতীয় দিন শিশু প্রহরে আসেন কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। তিনি বলেন, ছুটির দিনে সকালবেলা বাবা-মায়ের উচিত শিশুগুলোকে মেলায় নিয়ে আসা। আর স্কুলগুলোর উচিত দল বেঁধে একটা শ্রেণীকে একেক দিন মেলায় নিয়ে আসা। তারা বই নাড়বে। শিশুদের জন্য প্রকাশিত বইয়ের মান কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি ভিটামিন খাইয়ে শিশুদের বড় করতে পারবেন না। তাদেরকে খাদ্য দিতে হবে। যে খাদ্যের মধ্যে ভিটামিনটা প্রচ্ছন্নভাবে লুকায়িত থাকবে। আনিসুল হক আরও বলেন, শিশুদের একটা আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে। তারা সবসময় ভালো বই বেছে নেয়। আপনি তাকে গল্পের এবং আনন্দের এক অপরিসীম জগতে ছেড়ে দেন এর মধ্যে সে আনন্দ খুঁজে পাবে। ছন্দ পাবে, দোলা পাবে। এত দুশ্চিন্তার কিছু নেই যে শিশুদের জন্য উপদেশমূলক বই পড়তে হবে। বরং শিশুদের জন্য আমি যেটা চাইবো সেটা হলো নির্ভুল বই। বাক্যগুলো যেন নির্ভুল হয়, বানানেও যেন কোনো ভুল না থাকে। ছবিগুলো যেন সুন্দর হয়। তারপরে বইয়ের প্রতি এদের ভালোবাসা গড়ে উঠবে।
গতকালের অনুষ্ঠান: গতকাল ছিল আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের ৩য় দিন। সম্মেলনের প্রথম পর্ব আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে সকাল ১০টায় শুরু হয়। এ পর্বে বাংলা কবিতা বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কবি শ্যামলকান্তি দাশ এবং অধ্যাপক মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি অসীম সাহা, ইকবাল হাসান, তুষার দাশ, ফরিদ কবির। এই অধিবেশন সভাপতিত্ব করেন কবি আসাদ চৌধুরী। বিকাল ৩টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বে বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক শান্তনু কায়সার ও পশ্চিমবঙ্গের প্রাবন্ধিক সুমিতা চক্রবর্তী। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের গবেষক সুনন্দা সিকদার, কথাসাহিত্যিক পূরবী বসু, প্রাবন্ধিক মোরশেদ শফিউল হাসান, অধ্যাপক রফিকউল্লাহ খান, অধ্যাপক বেগম আকতার কামাল, পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র গবেষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, চীনের অনুবাদক ইয়াং উই মিং সর্না, পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ইমানুল হক। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক পবিত্র সরকার। বিকাল ৫টায় মূলমঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন, পশ্চিমবঙ্গের গবেষক জিয়াদ আলী, ড. আমিনুর রহমান সুলতান। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন। একই সময়ে শহিদ মুনীর চৌধুরী সভাকক্ষে সাহিত্য ও ফোকলোরের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. ফিরোজ মাহমুদ ও শাহিদা খাতুন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শফিকুর রহমান চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ জামিল আহমেদ, সাইমন জাকারিয়া ও সাকার মুস্তাফা। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অনুষ্ঠিত হয় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও অন্য ভাষার কবির স্বরচিত কবিতা এবং ছড়া পাঠ। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সুকুমার বড়ুয়া।
আজকের অনুষ্ঠান: মেলার ৪র্থ দিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের শেষ দিন। শিশু প্রহর হওয়ায় মেলার দ্বার খুলবে সকাল ১১টায়। চলবে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত।
নতুন বই: মেলায় গতকাল নতুন বই এসেছে ১৩০টি। মোড়ক উন্মোচন করা হয় ১৪টি বইয়ের। নতুন বইয়ের মধ্যে গল্প ১৩টি, উপন্যাস ২৮টি, প্রবন্ধ ৩টি, কবিতা ৪১টি, গবেষণা ৪টি, ছড়া ৭টি, শিশু সাহিত্য ৪টি, জীবনী ৪টি, মুক্তিযুদ্ধ ৭টি, নাটক ১টি, বিজ্ঞান ২টি, ভ্রমণ ১টি, ইতিহাস ৩টি, রম্য ১টি, সায়েন্স ফিকশন ১টি, অন্যান্য ১০টি।