নুরুল হুদা পলাশ, সাস্কাটুন , সাস্কাচুয়ান, কানাডা।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (আই সি ডি ডি আর বি ) চাকুরী করা কালীন চাকুরী সূত্রে আমাকে মাসে দুই থেকে তিনবার মতলব যেতে হতো। ভোর বেলায় রওনা হতাম। মগবাজার পার হয়ে মালিবাগ ঘুরে আমাদের অফিসের গাড়ি খিলগাঁও রেলগেট পার হয়ে অতীশ দীপঙ্কর সড়ক ধরে যাত্রাবাড়ী ক্রস করে মেঘনা ঘাটে পৌঁছতো। কোনোদিন একা আবার কোনোদিন অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে মতলব যেতাম। খিলগাঁও রেইল ক্রসিং এ প্রায়ই লম্বা জ্যাম লেগে থাকতো। সেই জ্যাম পার হতে কোনো কোনো দিন প্রায় আধা ঘন্টাও লেগে যেত। একদিন হটাৎ লক্ষ্য করলাম ক্রসিং পার হয়ে আমাদের মাইক্রোবাস ডানে মোর নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো কারণ সামনে লম্বা জ্যাম। আমাদের বা পাশে ঠিক রাস্তার ডিভাইডার এর ওপরে একটা অভাবনীয় দৃশ্য। মধ্যবয়সী একজন মহিলা রাস্তার আইল্যান্ডের ওপরে বসে ডিম খাচ্ছে। এমন মজার একটি দৃশ্য বেশ চোখে পড়ার মতো। মহিলার পরনের কাপড় চোপড় মলিন, চুলগুলো এলোমেলো হয়তো জটা ধরে গেছে। ঠিক আয়েশি ভঙ্গিতে বসে একটি ডিম হাতে নিয়ে খাচ্ছে। আমিই মনে হয় একমাত্র ব্যক্তি যে খুব মনোযোগের সাথে ব্যাপারটি খেয়াল করছি। খুব মনোনিবেশ সহকারে দেখছিলাম মহিলার ডিম খাওয়া। আমরা সেখানে পৌঁছার আগেই সে হয়তো সিদ্ধ ডিমটির খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছে। এখন খাচ্ছে। কিন্তু সে খাবার চেয়ে ডিম্ টিকে বিশেষ ভাবে খুলতেই বেশি মনোযোগী। খোসা ছাড়া ডিমের অগ্রভাগে আস্তে করে নিজের ডান হাতের দুইটি আঙ্গুল বসিয়ে একটু ভেঙে নিলো।ভাবলাম এখন বুঝি খাবে।না, ডিমটি এমন নিখুঁত ভাযে সে ভাঙছে যেন ডিমটি ব্যাথা না পায়। আমাদের গাড়ি খুব আস্তে এগুচ্ছে। মহিলার ডিম খাওয়া দেখে আমি নিজেই ধৈর্য হারা হয়ে যাচ্ছিলাম।একটা ডিম্ খেতে এতো সময় লাগে ? সে গভীর মনোযোগ দিয়ে ডিম্ টিকে আস্তে আস্তে ভাঙছে। একটু করে খাচ্ছে। এভাবে খেতে থাকলে তার যে ডিম্ শেষ করতে দুপুর হয়ে যাবে সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। আমাদের গাড়িও আগাচ্ছেনা। সামনে শুনলাম এক্সিডেন্ট হয়েছে তাই সময় লাগবে। প্রায় এক ঘন্টা আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলো আর এই এক ঘন্টায় মহিলা ডিমের চার ভাগের একভাগও শেষ করলোনা। এখন ডিমের কুমুস দেখা যাচ্ছে। হয়তো সে এভাবেই সারাদিন ধরে ডিমটি খাবে। আমার গভীর মনোযোগ দিয়ে এই মহিলার ডিম্ খাওয়া দেখে গাড়ির চালক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার কি দেখেন ? পাগলির ডিম্ খাওয়া? আমার সম্বিৎ ফিরে পেলো। হ্যা পাগলিই হবে। নাহলে এভাবে কেও ডিম্ খায় ? গাড়ি আস্তে আস্তে এগিয়ে চললো। আমি পিছন ফিরে বারবার তার ডিম্ খাওয়া দেখছিলাম যতক্ষণ না সে আমাদের আড়াল হয়। একসময় সে আমার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলো। আমি চালক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি ওকে কতদিন হলো দেখছেন ? সে জানালো অনেকদিন। অনেক দিন? একই জায়গায় ? হ স্যার। ও হইলো কুসুম পাগলী। খালি ডিমের কুসুম খায়। আমি মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলাম। কুসুম পাগলী। বেশ মজার ব্যাপার তো। ডিমের কুসুম খায় জন্যে কুসুম পাগলী, নাকি আসল নাম। স্যার হুনছি খুব বড় ঘরের মাইয়া ছিল। বড় লোকের সাথে বিয়াও হইছিলো। কিন্তু কি কারণে পাগলী হৈছে তা জানিনা। তয় সারাদিন ওখানে বইসা বইসা ডিমের কুসুম খায়। কেও টাকা পয়সা দিলেও নেয়না।
সারাদিন ডিমের কুসুম খায় ? হ স্যার। এতো ডিম কোথায় পায় ? কে দেয় ? আমি তা জানিনা স্যার। ব্যাপারটা মাথায় জট পাকাচ্ছিলো। একটা মানুষ সারাদিন বসে বসে ডিমের কুসুম খায়। কিন্তু আমি যা দেখলাম তাতে তো তাকে কুসুম খাওয়ার জন্যে খায় বলে মনে হলোনা। একটা ডিম্ খেতে তার সারাদিন লেগে যাবে। কি জানি। কত পাগলের কথা শুনেছি। মাটি বাবা, জুতা বাবা, শোয়া বাবা আরো কত কি। কুসুম পাগলী, এই প্রথম। কি বিচিত্র এই ধরণী আর কত বিচিত্র মানুষ আমরা তার কতজনের খবর রাখি।
যথারীতি মেঘনা ঘাট থেকে স্পিড বোট এ উঠে মতলব পৌঁছলাম। পৌঁছেই আমাদের সকালের নাস্তা দেয়া হতো। কত রকমের বাহারি নাস্তা। টেবিল এ এক ঝুড়ি সিদ্ধ ডিম্।যারা সিদ্ধ ডিম্ খাবেনা তাদের জন্যে ওমলেট, মামলেট সব বাবস্থাই আছে। আমি একটি ডিম্ হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে খাচ্ছি আর কুসুমের কথা ভাবছি। আমাদের একজন সিনিয়র কলিগ বেলায়েত পিয়ন কে ডেকে বললেন তার কুসুম ছাড়া ডিম রেডি কিনা। বেলায়েত মোলায়েম শুরে জানালো জি স্যার, রেডি। এর আগেও দেখেছি ব্যাপারটা কিন্তু সেদিনই একটু বিশেষ ভাবে খেয়াল করলাম। উনি এক বাটি কুসুম বিহীন ডিম খেয়ে ফেললেন। উনি ডিমের কুসুম খান না কারণ ওনার ডায়াবেটিস। সারাটা দিন আমার মাথায় কুসুম পাগলির ডিম্ খাওয়ার দৃশ্যটাই ঘুর পাক খাচ্ছিলো। হতে পারে ওটা নেহায়েত একজন পাগলের স্বাভাবিক আচরণ।কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটি একদমই সাধারণ মনে হয়নি। আস্তে ধীরে সারাদিন ধরে একটা ডিম খাচ্ছে যেহেতু তার আর কিছু খাবার নাই। অন্য কোনো কাজ নাই। এমনতো হতে পারে আমাদের গাড়ির চালক সাহেব যেমনটা বললেন, বনেদি ঘরের মেয়ে, কোনো একটা দুর্ঘটনা তার জীবনের সব ওলোট পালট করে দিয়েছে। কে জানে ঘটোনাটির সাথে হয়তোবা ডিমের কোনো সম্পর্ক আছে। প্রচন্ড আঘাত পেয়ে মেয়েটি তার স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। আস্তে আস্তে তার স্থান হয়েছে খিলগাঁ রেইল ক্রসিং এর এই আইল্যান্ড এ। একজন স্বাভাবিক মানুষ পাগলী হয়ে গেলে তার চিকিৎসা করানো হয়। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। কি দুর্ভাগ্য এই মহিলার যে কোনো একটা পাগলা গারোদেও জায়গা হয়নি। হয়তো তার ভালোবাসার প্রিয় মানুষটি এখন অন্য একজন সুস্থ সবল সুন্দরী বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মা হয়তো চোখের জল ফেলছেন আর বাবা তাকে শান্তনা দিয়ে যাচ্ছেন এই বলে “যে যাবার গেছে তাকে নিয়ে এতো ভেবে কি লাভ কুসুমের মা”। হয়তো তার সন্তানেরা জানেইনা তাদের মা এখনো জীবিত কিন্তু সে একজন পাগলী। আরো অনেক কিছুই হতে কিন্তু এ সবই আমার কল্পনা।
জীবনের গল্প বড়োই অদ্ভুত। কজন মানুষের জীবনের গল্প আমরা জানি। জানিনা। হয়তো আমি যা ভাবছি তার কোনোটাই সঠিক নয়। হতে পারে তার আসল নাম কুসুম। শুনেছি পাগলেরা দিনে অন্তত একবার খুব অল্প সময়ের জন্যে সম্বিৎ ফিরে পায়। সেই সময়টা এতই সামান্য যে তাতে স্বাভাবিক আচরণ প্রকাশের অবকাশ থাকেনা। কুসুমেরও সেটা হতে পারে। সেই সময়টাতে হয়তো সে শুধু ওই ডিমের কুসুম খাবার ব্যাপরটিই অনুভব করে।
ওই রাস্তা দিয়ে অনেকদিন গিয়েছি। তাকে আরো দেখেছি। ওই একই ভঙ্গিতে। কোনোদিন তার পুরো খাওয়া ডিম্ বা ডিমের কিয়দংশও হাতে দেখেনি। হতে পারে সে হয়তো ডিম্ খায়ইনা । ডিম্ হাতে নিয়ে আয়েশি ভঙ্গিতে বসে থাকা আর ডিমের দিকে তাকিয়ে থাকা এটাই তার আনন্দের একমাত্র বিষয়। শীতের সকালে, ঠান্ডায় কাঁপছে কিন্তু হাতে ডিম। বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু কুসম পাগলী ডিম্ হাতে রাস্তার আইল্যান্ডে বসে ডিমটিকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এর পর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। কখনো তাকিয়ে দেখেছি কখনো দেখিনি। পড়ালেখার জন্যে জাপানে পাড়ি জমালাম। প্রায় পাঁচ বছর পর দেশে গিয়েছি। কোনো একটি কাজে খিলগাঁ রইল ক্রসিং পার হচ্ছি সি এন জিতে। খিলগাঁ রেইল ক্রসিং তো আর আগের মতো নাই। ফ্লাই ওভার হয়েছে। আগের রাস্তার ওপরের কাঁচা বাজার নাই। রাস্তার জ্যাম নাই।হটাৎ মনে হলো সেই কুসুম পাগলির কথা। কিন্তু কোথায় কুসুম পাগলী ? তবুও কৌতহল সামলাতে না পেরে সি এন জি চালক কে জিজ্ঞেস করলাম ভাই এখানে কয়েক বছর আগে প্রায়ই একজন পাগলী রাস্তার মধ্যে বসে থাকতো, আপনিকি তাকে কখনো দেখেছেন? কইবার পারিনা স্যার। কুসুম পাগলী, শুধু ডিমের কুসুম খেত। কুসুম পাগলী ? হ স্যার দেখছি কিন্তু ফ্লাই ওভার হওনের পর আর দেহি নাই। কি জানি কই গেছে। টয় হুনছি আশেপাশের রেস্টুরেন্ট থাইকা খালি ডিম্ চুরি করতো। ট্রাফিক পুলিশ একবার তারে খুব পিটাইছিলো। তার পর থাইকা আর রাস্তার ওপরে বসে নাই।
কে জানে কোথায় হারিয়ে গেছে কুসুম পাগলী। হয়তো প্রচন্ড অভিমানে চলে গেছে দূরে বহুদূরে। কুসুমের জীবনের গল্প আমি পুরোপুরি জানিনা। জানার দরকার হয়নি। কৌতুহলের বসেই এতটুকু জানা।সবার জীবনের গল্প জানার মতো সময় আমাদের নাই, সেটা সম্ভবও না। কিন্তু এটা সত্যি, প্রতিটা মানুষেরই জীবনের গল্প থাকে। কারো কারো গল্প লেখা হয়, তারা সৌভাগ্যবান। কুসুমদের মতো অবহেলিত মানুষেরা জীবনের টানাপোড়নে এক সময় নিজের বৃত্ত থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় আর তারা ফিরতে পারেনা আপন বলয়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় আচ্ছা কুমুসের ডিম্ খাওয়া কি নিছক একটা পাগলীর মানসিক প্রতিবন্ধীর ডিম্ খাওয়া ছিল নাকি এর পিছনে রয়েছে তার জীবনের কোনো গল্প ? কি হবে জেনে সেই গল্প ? একটা গল্পই লেখা হবে হয়তো। কুসুমের জীবনে তো আর ফেলে আসা স্বপ্নময় দিন ফিরে আসবেনা। কিন্তু আমার জীবনে ব্যাপারটা একদমই ক্ষুদ্র একটা ব্যাপার না। কারণ আমি ডিম্ খেতে পসন্দ করি। আমি আমার ছেলে কে প্রতিদিন সকালে ডিম্ সিদ্ধ করে দেই যেন সে দিনে অন্তত একটা করে ডিম খায়। সে কোনোদিন খায় কোনোদিন খায়না। কিন্তু ডিম্ শব্দটা আমার মাথায় আসলেই কেন জানি কুসুম পাগলির কথা মনে পরে যায়। আর প্রায়ই আমি আমার স্ত্রীকে এই ছোট্ট গল্পটা বলি। একই গল্প বারবার বলি, সে কখনোই বিরক্ত হয়না। কুসুম পাগলির সেই আয়েশি ভঙ্গিতে বসে সারাদিন ধরে একটা ডিমের কুসুম খাবার গল্পটি আমার বৌ প্রতিবারই মনযোগ দিয়ে শুনে ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.