আইনুদ্দিন আহমেদ। বয়স ৫০। পেশায় কৃষক। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন। এসেছেন টাঙ্গাইল থেকে। তার মেয়ে জানিয়েছেন, অতিরিক্ত ধূমপান করার কারণে তার বাবা ফুসফুসের ক্যানসারে ভুগছেন। শুধু আইনুদ্দিন নন, দেশে বছরে এক লাখ ২২ হাজার লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মারা যায় ৯১ হাজার। বাংলাদেশে ১৫ লাখের অধিক ক্যানসার রোগী রয়েছেন। ক্যানসারের রোগী বেড়েই চলছে। দিন দিন রোগী বাড়লেও চিকিৎসা নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে রোগী এবং চিকিৎসকদের। এই পরিস্থিতিতে আজ বিশ্ব ক্যানসার দিবসে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করছে। বর্তমানে দেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল, ল্যাব এইড হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, এ যেসব রোগী আসেন তাদের একটি বড় অংশই ক্যানসারে আক্রান্ত। রোগটির বিস্তারে নানা কারণকে দায়ী করছেন বিশেজ্ঞরা যার প্রায় সবই মনুষ্য সৃষ্ট। এর মধ্যে একটা বড় কারণ হলো তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন। আর অতিমাত্রায় তামাকজাত দ্রব্য সেবনের কারণে আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস ক্যানসারে। আবার অনিরাপদ খাদ্যগ্রহণকেও চিকিৎসকরা ক্যানসারের একটি অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন। কৃষিতে রাসায়নিক ও কীটনাশকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার আমাদের খাদ্যদ্রব্যকে করে তুলছে অনিরাপদ। এর উপর রয়েছে ফলমূল ও মাছে ফরমালিনের ব্যবহার। বায়ুদূষণকেও ক্যানসার বিস্তারের অরো একটি কারণ বলে মনে করেন তারা। বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি ক্যাসারের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
গবেষণা বলছে, ক্যানসার আক্রান্ত প্রতি ২ লাখ মানুষের জন্য দু’টি রেডিও থেরাপি সেন্টার প্রয়োজন। কিন্তু অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি রেডিও থেরাপি সেন্টার আছে ১৫টি। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এর মধ্যে সরকারি আছে ৯টি বেসরকারি ৬টি। যার সবগুলোর মেশিন আবার সমভাবে সচল নয়। জানা গেছে, মোট ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর মধ্যে ৬০ শতাংশই পুরুষ। পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৩ শতাংশ আক্রান্ত হচ্ছে ফুসফুস ক্যানসারে, লিপ অ্যান্ড ওরাল ক্যানসারে ১২ শতাংশ, অন্ননালির ক্যানসারে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এছাড়া আছে পাকস্থলী, হস্কিন লিম্ফোমা, মূত্রনালি, লিভার ও লিউকোমিয়া ক্যানসার। অন্যদিকে নারীদের মধ্যে ৩৩ শতাংশই ব্রেস্ট ক্যানাসারে আক্রান্ত। বিশেজ্ঞরা জানান, ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সীরাই ক্যানসারে আক্রান্ত হন সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে থেমে নেই শিশুরাও। শিশুরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত লিউকোমিয়ায়।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইন্সটিউটের পরিসংখ্যান মতে, ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত দেশে ক্যানসার আক্রান্তদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। ২০১১ সালে এই ইনস্টিটিউইটের অধীনে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৪৯৮ জন, ২০১২ সালে ৩০২০ জন, ২০১৩ সালে ৩০৪৫ জন, ২০১৪ সালে ৪০৫৭ জন, ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২৮৫ জনে। সূত্র মতে,২০১৬ সালে তা ১১ হাজারে। এরমধ্যে ২০১১ সালে মারা যায় ৯২ জন। ২০১২ সালে ৯৫ জন। ২০১৩ সালে ১১৮ জন, ২০১৪ সালে ৯০ জন, এবং ২০১৫ সালে ১৬৮ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যানসারের লক্ষণ দেখা দেয়া মাত্রই দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। ক্যানসারের লক্ষণ হিসেবে তিনি জানান, হঠাৎ করে গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যাওয়া। শরীরের যে কোন জায়গায় চাকা হলে তা বৃদ্ধি পাওয়া। অস্বাভাবিক রক্তপাত। যে কোন ঘা না সারা। পায়খানা ও প্রস্রাবের অভ্যাসের পরিবর্তন। দীর্ঘদিন ধরে খুসখুসে কাশি থাকা। দীর্ঘদিনের জ্বর। কারণ ছাড়া ওজন অতিরিক্ত পরিমাণে হ্রাস পাওয়া। এসব লক্ষণ দেখা দিলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অনকোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান সৈয়দ আকরাম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সচেতনতার অভাবে রোগের একেবারে শেষ পর্যায়ে চিকিৎসকের কাছে আসে মানুষ। ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ রোগীর রেডিয়েশন থেরাপি দরকার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আনুমানিক ১৫ লাখ ক্যানসার আক্রান্ত রোগী আছে। এই বিশেষজ্ঞ তামাক ব্যবহার পরিহার করার পরামর্শ দেন। তামাক ব্যবহারের ফলে বেশির ভাগ ক্যানসার হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি জানান, তামাক নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসবে। এজন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যানসার ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন তার এক প্রবন্ধে বলেন, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রতি বছর ৮২ লাখ মানুষ ক্যানসারে মৃত্যবরণ করে। এর মধ্যে ৪০ লাখ ঘটে অকালমৃত্যু, ৩০ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে। ২০১৬-২০১৮ এই তিন বছরের জন্য এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘উই ক্যান, আই ক্যান’। আমরা পারি, আমি পারি। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে কিছু কাজ সম্মিলিতভাবে সফল করতে পারি। আবার ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকেই পারি ক্যানসারের বোঝা লাঘবে ভূমিকা রাখতে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের উপর ক্যানসারের ক্ষতিকর প্রভাব লাঘবে সবারই সুযোগ আছে ব্যবস্থা নেয়ার। বাংলাদেশের বর্তমান ক্যানসার পরিস্থিতি বিশেষণ ও উত্তরণে করণীয় সম্পর্কে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার (আইএআরসি)’র অনুমিত হিসাব অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে এক লাখ ২২ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়, মারা যায় ৯১ হাজার। যে কোন দেশে ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য দরকার ক্যানসারে আক্রান্তের হার, মৃত্যুর হার, কারা কোন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে সেই সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান। এর জন্য প্রয়োজন জনসংখ্যা ভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন তদারকির জন্য গঠিত উচ্চপর্যায়ের ‘জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিল’ প্রায় অকার্যকর। দির্ঘদিন এই পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ক্যানসার নিয়ন্ত্রণের ৪টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। প্রাথমিক প্রতিরোধ, সূচনায় ক্যানসার নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রশমন সেবা বা পেলিয়েটিভ চিকিৎসা। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশে ক্যানসারের জন্য বরাদ্দের সিংহভাগ ব্যয় হয় অবকাঠামো ও চিকিৎসা সরঞ্জামের পিছনে। ক্যানসার নির্ণয় ও স্ক্রিনিং খাতে বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত। প্রাথমিক প্রতিরোধের প্রধান উপাদান ক্যানসারের ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা ও টিকাসহ সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। এ ক্ষেত্রটি সবচেয়ে অবহেলিত। সরকারের কিছু উদ্যোগ আছে বিভিন্ন প্রোগ্রামের মধ্যে ছড়িয়ে, সমন্বয়ের অভাবে তা দৃশ্যমান প্রভাব ফেলতে পারছে না। বেসরকারি সংগঠনগুলি মূলত সচেতনতা কার্যক্রমকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুমিত বিপুলসংখ্যক রোগীর চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। দেশের একমাত্র বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানটিতে সারা দেশের রোগী, যাদের প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসার সামর্থ্য নেই, তারা ভিড় জমাচ্ছেন। অপারেশনের জন্য গড়ে একমাস, কেমোথেরাপির জন্য ২ থেকে ৩ সপ্তাহ, বিকিরণ চিকিৎসার জন্য ৪ মাস পর্যন্ত অনেককে অপেক্ষা থাকতে হচ্ছে। ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীও গ্রহণযোগ্য হয় না।