রাত তখন প্রায় ৮টা। রাণীর মোবাইলফোনে একটি কল আসে। রিসিভ করে কথা হয় দু’জনের। তারপর আর দেরি করেননি। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়ে যান নীল আক্তার রাণী। এই যাওয়াই ছিলো তার শেষ যাওয়া। সেদিন কে তাকে ফোনে ডেকেছিলো, কেন ছুটে গিয়েছিলেন রাণী? এসব বিষয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কিন্তু কূটনৈতিক জোন গুলশানে চাঞ্চল্যকর রাণী হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি পুলিশ। অবশেষে মামলাটি ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাণী হত্যার খবর পেয়ে পরদিন ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন তার স্বজনরা। রাণীর বান্ধবীদের বরাত দিয়ে তার বোন তানিয়া জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের সামনে রাণীর এক বান্ধবী তাকে বলেছিলো, ঘটনার দিন রাতে একসঙ্গেই আড্ডা দিচ্ছিলেন তারা। তখন রাত প্রায় ৮টা। রাণীকে ফোন দিয়ে এক ব্যক্তি গুলশানে যেতে বলেন। ওই ব্যক্তির কাছে রাণীর পাওনা ১০ হাজার টাকা ছিলো। ওই টাকা দেবে বলেই রাণীকে ডেকে নেয়া হয়। তানিয়া জানান, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর রাণী তার বান্ধবীর ফোনে কল দিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাকে গুলি করছে। বোন আমাকে বাঁচা…।’ তারপর কণ্ঠ থেমে যায়। ‘হ্যালো হ্যালো’ করেও কোনো সাড়া পাননি বলে জানান রাণীর ওই বান্ধবী। রাত দুইটার দিকে একজন অটোরিকশা চালকের মাধ্যমে রাণীর বান্ধবীরা জানতে পারেন গুলশান-২ এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় রাণী মারা গেছে। তারা সবাই ছুটে যান সেখানে। ততক্ষণে লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। কিন্তু ওই নারীর নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি তানিয়া। গতকাল বুধবার বিকালে রাণীর দুই বোন শাহনাজ বেগম, তানিয়া বেগম ও ভাই মুরাদ হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, রাণীর ওই বান্ধবীকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হতে পারে। রাণীর প্রাক্তন স্বামী আলম জানান, রাণীর বান্ধবী শেলীর মাধ্যমে মৃত্যুর খবর পায় আলম ও রাণী দম্পতির ছেলে শান্ত। শান্তর মাধ্যমে এই খবর পান আলম। পরে তার মোবাইলফোন থেকে কল দিয়ে ঢাকার বাইরে থাকা রাণীর ভাইবোনকে তা জানান। রাণীর সঙ্গে প্রায় এক বছর আগে তার ডিভোর্স হয়েছে জানিয়ে আলম বলেন, তারপর থেকে রাণী তার মতো করে চলাফেরা করতো। যে কারণে কারা, কেন তাকে হত্যা করেছে এ বিষয়ে কোনো ধারণা করতে পারছেন না তিনি। হত্যাকাণ্ডের পর রাণীর বান্ধবী শেলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। কে ওই ব্যক্তি যার কল পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন রাণী। তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করলেও তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সালাহউদ্দিন মিয়া বলেন, রাণীর বান্ধবী শেলী এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়নি। তবে রাণীর কললিস্টের সূত্রধরে তদন্ত করা হয়েছে। একইভাবে ঘটনাস্থলে সিসি টিভির ফুটেজে যে কালো গাড়ি যেতে দেখা গেছে ওই গাড়িটির সন্ধান করা হয়েছে বলে জানান তিনি। এখন বিষয়টি তদন্ত করছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। জানা গেছে, বুধবার রাতে মামলার কাগজপত্র ডিবিতে হস্তান্তর হয়েছে। এ বিষয়ে ডিবি’র সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুল আলম রাসেল বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারসহ নানা প্রক্রিয়ায় বিষয়টি তদন্ত করা হবে। বৃহস্পতিবার থেকেই ডিবি’র তদন্ত সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজনীয় ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলে জানান তিনি। এদিকে, কুড়িল বিশ্বরোডের কাজীবাড়ি এলাকায় যে বাসায় থাকতেন রাণী, তার পাশের একটি কক্ষে থাকেন শেলী। ঘটনার পর থেকে এ বিষয়ে শেলী, পারভিনসহ রাণীর বান্ধবীরা অজানা আতঙ্কে মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। কুড়িল এলাকায় সিএনজিচালক থেকে শুরু করে ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের কাছে পরিচিত মুখ রাণী। ছেলে শান্তকে গ্রামের বাড়ি জামালপুরে রেখে কুড়িলের ছোট্ট বাসায় থাকতেন তিনি। পাঁচ বছরের নন্দিনী নামে একটি মেয়ে রয়েছে তার। ওই মেয়েকে প্রতিবেশী বান্ধবীদের বাসায় রেখে সন্ধ্যা হলেই সেজেগুজে বাইরে বের হতেন রাণী। গভীর রাতে বাসায় ফিরতেন। কখনো ফিরতেন সকালে। এলাকাবাসী জানান, তার সঙ্গে বিভিন্ন শ্রেণির পুরুষদের যোগাযোগ ছিলো। এজন্য রাণীর ফোনের কললিস্ট ও তার বান্ধবীদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই হত্যা রহস্য উন্মোচন হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। রাণী হত্যার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তার ভাই মুরাদ হাসান। তিনি বলেন, রাণী কাদের সঙ্গে চলাফেরা করতো, কি করতো তা জানা ছিলো না আমাদের। আমরা গরিব মানুষ পেটের দায়ে নিজের জন্মস্থান ছেড়ে সিলেটে পড়ে আছি। রাণী আপা থাকতো ঢাকায়। আমাদের খুব কম যোগাযোগ হতো। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেছেন তারা। উল্লেখ্য, গত ২৭শে জানুয়ারি দিবাগত রাত ২টার দিকে গুলশান-২ এর ৩৮ নম্বর সড়ক থেকেই রাণীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করলেও পরবর্তীতে লাশের পোস্টমর্টেমকালে চিকিৎসকরা জানান, গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে রাণীর। এ বিষয়ে রাণীর ভাই মুরাদ হাসান বাদী হয়ে গুলশান থানায় মামলা করেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.