বছর ঘুরে আবারও এসেছে ফেব্রুয়ারি; ভাষার মাস, আবেগের মাস। আমাদের প্রচলিত প্রবণতা অনুসারে ভাষা নিয়ে আলোচনা করার মাস। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি, এ মাস ঘিরেই আমাদের বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা কিংবা ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের যত আকুতি। আবার এটাও সত্যি, বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও মর্যাদা রীতিমতো হুমকির সম্মুখীন। শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোয় ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১২ তারিখে ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’ শিরোনামে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ এক উপসম্পাদকীয় লিখেছিলেন। এখানে তিনি বিভিন্ন বাস্তব উদাহরণ উল্লেখসহ ভাষা দূষণ ও এর পরিণাম নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, যা বর্তমান বাস্তবতায় যেন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ বিগত চার বছরে বাংলাদেশের নদীদূষণ ও ভাষাদূষণ দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এবং ক্রমাগত বাড়ছে। তবে এফএম রেডিওগুলোতে বাংলা-ইংরেজির অদ্ভুত মিশেল ও বিকৃত উচ্চারণ এবং ডিজুস প্রজন্মের কথোপকথন আমাদের এখন আর আগের মতো পীড়া দেয় না। বরং এগুলো এখন গা-সওয়া বা কান-সওয়া যেটাই বলি না কেন আমাদের এক প্রকার সহ্যই হয়ে গিয়েছে। এগুলো নিয়ে লেখালেখি বা প্রতিবাদ এখন কদাচিৎ বা ফেব্রুয়ারি মাসের রুটিন আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ। যেমন আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনে সম্বোধন হিসেবে ব্রো (ভাই), সিস (বোন), মেট (বন্ধু) ইত্যাদি এখন বেশি প্রচলিত।
আবার, বর্তমানে ভাষা দূষণের নতুন উপদ্রব অশ্লীল শব্দের ব্যবহার। এখন বিনোদন, আনন্দ বা হাসি-ঠাট্টা মানেই কতিপয় বিশেষ বর্গীয় শব্দের সাবলীল ব্যবহার। যেমন ফেসবুক-ট্রল ও ইউটিউবের কিছু বিনোদনধর্মী ভিডিওগুলো যেন বিকৃত শব্দের পাশাপাশি অশ্লীল ও নোংরা শব্দ ও গালাগালির সমাহার। সবচেয়ে দুঃখজনক যে, এদের দর্শকপ্রিয়তা ও জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদের দর্শক সংখ্যা লাখের ওপর। তার মানে এই অশ্লীলতারও গ্রহণযোগ্যতা আছে ও এক শ্রেণির দর্শক এগুলো রীতিমতো উপভোগ করছেন। অথচ আমাদের সামনে ইত্যাদির মতো নির্মল আনন্দ-কৌতুক অনুষ্ঠানের উদাহরণ আছে। যেখানে বুদ্ধিদীপ্তভাবে বিভিন্ন অসংগতি কৌতুকের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে। আবার ফেসবুক লেখাতেও অশুদ্ধ-বিকৃত বাংলা বানানের পাশাপাশি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার বেড়েই চলছে। ফেসবুকে যাদের হাজার বন্ধু ও অনুসারী এবং যাদের লেখা হাজারবার পড়া ও শেয়ার করা হয়, তারা যেন সচেতন ও স্বচ্ছন্দভাবে আরও অধিক বিনোদন দেওয়ার প্রচেষ্টায় অশুদ্ধ-বিকৃত ও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করছেন। গীবন (জীবন), অকা (ওকে), কুতায় (কোথায়) ইত্যাদি বিকৃত ও অশুদ্ধ শব্দাবলিসহ তেনা প্যাঁচানোর মতো বাজে ও আরও বিশেষ বর্গীয় অশ্লীল শব্দ ছাড়া এদের অনুভূতি প্রকাশ সম্পূর্ণ হয় না। ভাষার সৌন্দর্যহানির ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ের বাংলা নাটক ও টেলিফিল্মের ভূমিকা উল্লেখ না করলেই নয়। বিনোদনের নামে অত্যন্ত স্থূল ভাঁড়ামি, আঞ্চলিক শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহারে প্রমিত বাংলাকে বেশ পরিকল্পিতভাবেই বিদায় দেওয়া হয়েছে। তাই নাটকে উচ্চবিত্ত চরিত্রদের খাইসি, করসি, গেসি শব্দাবলি ও গ্রামীণ পটভূমিকার সংলাপসমূহ বিশেষ করে ময়মনসিংহের আঞ্চলিক শব্দ ‘ফিহিন্নী/ফিকিন্নী’ যেন যেকোনো পর্যায়ের মনের ভাব প্রকাশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অথচ এই বাংলা নাটকে প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ ময়মনসিংহের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন, যা একই সঙ্গে শিল্পমান ও আবেগ-অনুভূতি প্রকাশে ভিন্নমাত্রা সংযোজন করেছে। যেমন তার নাটকে আঞ্চলিক ভাষায় বিভিন্ন দার্শনিক, রসাত্মক ও কৌতুকপূর্ণ সংলাপের পাশাপাশি কন্যাশিশুকে বাবা কর্তৃক সর্বদা ‘আম্মা/আপনি’ সম্বোধন বাবার অপত্যস্নেহের সঙ্গে পরিবারে কন্যাশিশুর সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বাংলা ভাষার সৌন্দর্যহানির পাশাপাশি এর মর্যাদাহানিও একই তালে চলছে। প্রবাসে, বিশেষ করে লন্ডনে বহু জাতি, বর্ণ ও ভাষাভাষীদের মাঝে এই উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানিরা বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠ। আবার ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের পারস্পরিক সখ্যতা সহজাত ও স্বাভাবিক। কিন্তু এই সহজাত সখ্যতা ও বন্ধুত্বে আমরা বাংলাভাষার অমর্যাদা করছি। যেমন কর্মক্ষেত্রের সহকর্মী, প্রতিবেশী, বন্ধু বা সহপাঠী হিসেবে কোনো ভারতীয় বা পাকিস্তানির সঙ্গে পরিচয়ের প্রাথমিক পর্যায়ে হিন্দি/উর্দু জানা আছে কিনা তাদের এরূপ আহ্বানে আমরা শুধু জানা বা বোঝা নয়, এ দুটি ভাষায় আমাদের দক্ষতা প্রকাশে বাংলা ভাষার ঐতিহ্য ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করতে আমরা এতটুকুও কুণ্ঠিত হই না। এদের সঙ্গে হিন্দি/উর্দু ভাষাতেই কথা বলি। যার ফলে সেই ভারতীয়–পাকিস্তানি সহকর্মী, প্রতিবেশী, বন্ধু বা সহপাঠীর মুখ থেকে পরবর্তীতে একটি ইংরেজি শব্দও বের হয় না। তারা যেকোনো বাংলাদেশিদের সঙ্গে হিন্দি/উর্দুতেই আলাপচারিতা শুরু করেন। ভিন্ন ভাষা বলতে বা বুঝতে পারা অবশ্যই একটি অতিরিক্ত যোগ্যতা। কিন্তু সেটা আরবি, ইংরেজি, ফরাসি বা চাইনিজ না হয়ে শুধুমাত্র হিন্দি/উর্দুতে সীমাবদ্ধ রেখে উপযাচক হয়ে এ ভাষায় কথা বলা নিজের মাতৃভাষাকে অপমান করারই নামান্তর। অথচ এই খোদ লন্ডন শহরে বাংলাদেশি অধ্যুষিত যেমন ব্রিকলেন, হোয়াইটচ্যাপল বা শেডওয়েলের মতো এলাকাগুলোতে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা নামফলক শোভা পায় যা প্রথম দিকের বাংলাদেশি অভিবাসীদের ত্যাগ ও প্রচেষ্টা মনে করিয়ে দেয়। বাংলা একটি সমৃদ্ধ, সৌন্দর্যমণ্ডিত, শ্রুতিমধুর ও সহজ ভাষা। মনের আবেগ ও ভাব প্রকাশে বাংলাভাষায় শব্দের প্রাচুর্যতা নিয়ে গর্ব করা যায়। অথচ আমরা অযথা স্মার্টনেস প্রমাণ করতে গিয়ে অশুদ্ধ ও বিকৃত শব্দ ব্যবহার করছি। বিনোদনের নামে অশ্লীল ও নোংরামি প্রচার করছি। অল্পবয়সী ও তরুণদের এ ধরনের প্রবণতা নিঃসন্দেহে যথার্থ পারিবারিক শিক্ষার অভাব ও ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। বলতে বাধা নেই অনেক তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারে গালি ও অশ্লীল শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। তাই তারাই পরবর্তীতে স্বভাবজাতভাবে অশুদ্ধ-বিকৃত ও অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে মায়ের ভাষার সৌন্দর্য এবং মর্যাদাহানি করছেন। আমরা অনেকেই হয়তো বিস্মৃত হয়েছি, ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বাংলা ভাষার দূষণ ও বিকৃতি রোধে একটি রিট আবেদন দায়ের করা হয়েছিল এবং আদালত ভাষার পবিত্রতা রক্ষার জন্য একটি রুল জারি করেছিলেন। ওই আদালতের আদেশ মোতাবেক বাংলা ভাষার দূষণ, বিকৃত উচ্চারণ, সঠিক শব্দচয়ন, ভিন্ন ভাষার সুরে বাংলা উচ্চারণ ও বাংলা ভাষার অবক্ষয় রোধে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। এই কমিটি কতিপয় সুপারিশ করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালে একটি স্থায়ী কমিটিও গঠিত হয়। কিন্তু কতিপয় অগ্রগতি সত্ত্বেও এই রুল এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি। ভাষার বিকৃতি ও মর্যাদা রক্ষায় উচ্চআদালতের চূড়ান্ত নির্দেশনা এখন সময়ের দাবি। কারণ আমাদের প্রাণের ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা বিকৃত, অশুদ্ধ শব্দের পাশাপাশি অশ্লীল শব্দের আগ্রাসনে ক্ষতবিক্ষত ও অপবিত্র হচ্ছে। এর ফলে ভাষা আন্দোলনে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকারীদের অবদানের সঙ্গে আমরা প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারি।
তথ্যসূএ: ইন্টারনেট
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.