লন্ডনকে বলা হয় তৃতীয় বাংলা। বিদেশে সবচেয়ে বেশি বাংলা ভাষী মানুষের শহর লন্ডন। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাঙালিরা আসতে শুরু করেন এখানে। কাজের সন্ধানে। যুদ্ধে ব্রিটেনের ক্ষতি হয় অপূরণীয়। রাস্তাঘাট-কলকারখানা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। মারা যায় অগণিত মানুষ। দেশ পুনর্গঠনে লোকবল প্রয়োজন ছিল। বিদেশি শ্রমিক আনতে শুরু করে ব্রিটেন। বাঙালিরা সে সুযোগ গ্রহণ করে। তখন ব্রিটেনে আসতে ভিসা লাগত না। লোকজন আসতেন ভাউচার নিয়ে। জাহাজে চেপে। বৈরী আবহাওয়া, ভাষার দুর্বোধ্যতা ও বর্ণবাদীদের রুখতে-রুখতে বাঙালি একদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। যারা এসেছিলেন কাজের সন্ধানে, তারাই একদিন স্বপ্ন দেখলেন, স্থায়ীভাবে বসবাসের। ব্রিটিশ সরকার অনুমতি দিল। পরিবার আনার। শুরু হলো বসতি। ছেলেমেয়ে বড় হলো। জজ-ব্যারিস্টার হলো, মেয়র হলো, রাষ্ট্রদূত হলো, এমপি হলো। চারদিকে গৌরবগাথা।
লন্ডনে যত বাঙালি থাকেন, তার প্রায় ৮০ ভাগই বৃহত্তর সিলেট এলাকার লোক। যাদের বলা হয় ‘সিলেটী’। তাদের নিজস্ব ভাষা আছে। তারপরও প্রধান ভাষা-বাংলা। বাঙালিরা দুটি জিনিসকে খুব ভালোভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে ব্রিটেনে। ভাষা ও রেস্তোরাঁর ব্যবসা। লন্ডনে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলা টাউন। রাস্তা, বাস, ট্রেনে সর্বত্রই বাংলাভাষী মানুষেরা সরব। তাদের প্রতিষ্ঠিত রেস্তোরাঁর ব্যবসায় বাৎসরিক টার্নওভার ৪ বিলিয়ন ডলার। অনেক দেশের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। এই অর্জন বাঙালির। এত অর্জনের পরও বাঙালি এখন বদলে যাচ্ছেন। একসময় লন্ডনপ্রবাসীরা দেশ ছাড়া কিছুই ভাবতেন না। যা রোজগার করতেন, খরচ বাদে সবই পাঠিয়ে দিতেন দেশে। সেই টাকায় সংসার চলত। ভাই-বোন, ভাতিজা-ভাইঝির পড়াশোনা, ইমারত নির্মাণ, ফসলি জমি, ব্যবসা, বিয়ে-শাদি সব। নিজের ব্যাংক হিসাব শূন্য রেখে, পূর্ণ করতেন ভাই-ভাতিজার হিসাব। একদিন দেখলেন, কঠোর পরিশ্রমে তিনি যা গড়েছেন দেশে, কিছুই তার না। দাবি করলে মামলা, হত্যার হুমকি। নিজে না খেয়ে, সন্তানদের বঞ্চিত করে, তিনি যে স্বপ্ন তৈরি করেছিলেন, তা ভেঙে গেল নিমেষেই। বালুর বাঁধের মতো। তাই এখন তারা আর টাকা পাঠান না আগের মতো। আগের মতো আর দেশে যান না প্রতি বছর। এখন সন্তান নিয়ে হলিডে করেন অন্য কোনো দেশে। দেশ খুব কষ্ট দিয়েছে তাকে। একসময় শীত ও গ্রীষ্মকালের ছুটিতে ব্রিটেনপ্রবাসীদের হিড়িক লেগে যেত দেশে যাওয়ার। কমিউনিটি সেন্টারগুলো পরিপূর্ণ থাকত তাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদির উৎসবে। এখন সেদিন আর নাই। ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদি দিতে কেউ আর বাংলাদেশ যান না। গেলেই বিপত্তি। আত্মীয়স্বজনদের টানাটানি। আমার ছেলের কাছে দাও। তোমার মেয়ে চাই আমার ছেলের জন্য। আছে নিরাপত্তার প্রশ্ন। তারপর বিদেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেশি ছেলেমেয়েদের বনিবনা হয় না। সংসার ভেঙে যায়। দেশে গেলে খরচ বেশি। আর তাই তো এই বদলে যাওয়া। এ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তাপ, হরতাল, ভাঙচুর, ঘুম, অনেক প্রবাসীকে ভয়ার্ত করেছে। প্রবাসীরা তার সন্তানকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ দেখাতে চান না। চান না সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ শেখাতে। ফলে কি হচ্ছে? বদলে যাচ্ছেন তারা। প্রবাসের নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে পাশ্চাত্যের ভঙ্গিমায়। বাংলাদেশ হয়ে উঠছে স্মৃতিময় একটা দেশ। যেখানে বাবা থাকতেন কিংবা পিতামহ। এইটুকুই। তাহলে আমাদের অর্জন কি সবই ভেসে যাবে? কেন যাবে? প্রবাসীদের দেশপ্রেম কম না। তারা না খেয়ে দেশ বাঁচিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে ব্রিটিশ-বাঙালিরা তাদের বেতনের একাংশ তুলে দিয়েছেন প্রবাসী সরকারের হাতে। প্রচণ্ড শীতে ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। পৃথিবীকে জানান দিয়েছেন স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার। এতসব করেও তারা এখন কিনারাহীন। সন্তান মানুষ হয়েছে ঠিক, দেশও স্বাধীন হয়েছে কিন্তু দেশে যেতে ভয়। সন্তান বাংলা জানে না। শাড়ি-লুঙ্গি উঠে গেছে। তারা যেন কিছুতেই মানতে পারেন না এসব। তারা বদলাতে চান না। চান বাঙালি হয়েই মরতে। লাল সবুজের দেশ বুকে নিয়ে ক-খ পড়তে-পড়তে। রক্তের বাঁধনকে বুকে টেনে। কিন্তু কোথায় যেন গরমিল। কোথায় যেন একটা বদলের গান। আবদুল আলিম না, আব্বাসউদ্দীন না, জেনিফার লপেজ, ভিভা। কেন এই সব! তারা মানতে পারেন না। কিছুতেই না। তাদের আর ভালো থাকা হয় না। কিছুতেই না। কিছুতেই।
তথ্যসূএ: ইন্টারনেট
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.