আহসান হাবীব নীলু ও গোলাম মাহবুব, চিলমারী থেকে ফির
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ হবে না, মঙ্গা থাকবে না। দারিদ্র্য ও ক্ষুধায় কেউ কষ্ট পাবে না। দেশের একটি মানুষও না খেয়ে মরবে না। তিনি বলেন, কুড়িগ্রামে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা ও নদীভাঙনে যারা গৃহহারা হয়েছে, তাদের জমি দেব, ঘরবাড়ি দেব। যারা দরিদ্র-ক্ষুধার্ত তাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার ব্যবস্থা করব। বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যাবে না। সব ছেলেমেয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
বুধবার কুড়িগ্রামের চিলমারীতে ‘খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি’ উদ্বোধন করতে এসে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের যারা হতদরিদ্র কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের ১০ টাকা কেজিদরে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। পুরো দেশে যে মাসে কাজ থাকে না, সে সময়ে বছরে ৫ বার চাল বিতরণ করা হবে।
হতদরিদ্র মানুষের মাঝে প্রতি কেজি ১০ টাকা দরের ৩০ কেজি করে চাল বিতরণের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে খাদ্যবান্ধব এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। ‘শেখের বেটি হাসিনা হামাক ১০ ট্যাকায় চাউল খোওয়াইবে। এটা হামরা কল্পনাতেও আনবার পাই নাই। হামার দুঃখের দিন তো শ্যাষ হয়া গেইল বাহে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে ৩০ কেজি চাল পেয়ে আনন্দে আত্মহারা ষাট বছরের বৃদ্ধ ফাতেমা বেগম এ অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেন।
একে একে এলাকার হতদরিদ্র ফাতেমা বেগম, হালিমা বেগম, শ্রীমতী বাসন্তি রানী, শ্রীমতী মালতি রানী, জিয়ারা খাতুন, রশিদা খাতুন, আ. হক, আজিজুল হক, জাহাঙ্গীর আলম, আবু বকর সিদ্দিক, আলিফ উদ্দিন, আমজাদ হোসেন, মোস্তফা আলী, আ. খালেক ও ফরিদ উদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে এ চাল পেয়ে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়েন।
শেখ হাসিনা বলেন, একদিকে আমরা দেশের দুর্ভিক্ষ দূর করার চেষ্টা করছি। অপরদিকে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, সৃষ্টি করেছে বিএনপি-জামায়াতসহ জোট সরকার। পরপর কয়েকটি সন্ত্রাসী ঘটনার পর মাত্র ১০ ঘণ্টার মধ্যে আমরা জঙ্গিদের প্রতিহত করে উদ্ধার কার্যক্রম সফল করেছি। তিনি বলেন, ইসলামে কোথাও মানুষ খুন করার কথা বলা নেই। যারা মানুষ খুন করে তারা ইসলামের লোক হতে পারে না। এদের সম্পর্কে সজাগ হতে হবে। এজন্য জনমত তৈরি করতে হবে। আমাদের যুব সমাজ আমাদের সম্পদ, তারা যাতে বিপথে না যায়, মাদকাসক্ত না হয় এজন্য বাবা-মা, শিক্ষক, নির্বাচিত প্রতিনিধিসহ সবার কাছে আবেদন, আপনাদের সন্তানরা কে কোথায় যায় সে ব্যাপারে নজর রাখুন। তাদের কথা শুনুন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কুড়িগ্রাম শুনলে মঙ্গা শুনতে হয়। বৃহত্তর রংপুরে মঙ্গা শব্দটা আর মুখে বা কানে যেন শুনতে না হয় এজন্য কাজ শুরু করা হয়েছে। তিনি বলেন, সারা দেশ ঘুরে দেখেছি। দেখেছি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। ছিয়ানব্বই সালে সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের মানুষের উন্নতি হয়েছে। আমাকে বাংলার মানুষ সুযোগ দিলে দেশে সব দুঃখী মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দিতে চাই। মানুষ যেন না খেয়ে কষ্ট না পায়, এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি ভারতের কাছে ছিটমহল বিনিময় ও সীমানা নির্ধারণের কথা উচ্চারণ করার সাহস পায়নি। কিন্তু আমরা শান্তিপূর্ণভাবে স্থলসীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন করেছি। আমরা ছিটমহল বিনিময় করেছি। সারা বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছি। বাংলাদেশের জন্য এটি ঐতিহাসিক ঘটনা। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে বিশাল সমুদ্র এলাকা বাড়িয়েছি। তিনি বলেন, যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার করেছি। ’৭১ সালে যারা নির্যাতন, হত্যা ও লুটপাট করেছে সেসব যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর করা হয়েছে। বাংলাদেশ কলংকমুক্ত হচ্ছে।
শেখ হাসিনা বলেন, চিলমারী বন্দরের পুরনো ঐহিত্য ফিরে আনার জন্য কাজ করা হবে। চিলমারী থেকে পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করা হবে। কুড়িগ্রামের ১৬টি নদীর নাব্য দূর করার জন্য ড্রেজিং করা হবে। এজন্য সমীক্ষার কাজ চলছে। এছাড়া দ্বিতীয় ধরলা ব্রিজ ও রাস্তা নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে। রেল সংযোগ আরও উন্নত করা হবে। তিনি বলেন, ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধামুক্ত-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ে তুলব। এজন্য স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে দিতে। আওয়ামী লীগের হাতকে শক্তিশালী করুন। আ’লীগের পতাকাতলে সমবেত হোন।
প্রধানমন্ত্রী বেলা ১১টায় সভাস্থলে উপস্থিত হন। এর আগে তিনি হেলিকপ্টারযোগে চিলমারী হেলিপ্যাডে অবতরণ করেন। ব্যাপক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্য দিয়ে এক কিলোমিটার দূরে সভাস্থলে আসেন তিনি সড়কপথে। এ সময় রাস্তার দু’ধারে হাজার হাজার মানুষ তাকে এক নজর দেখার জন্য ভিড় জমায়। হাত নেড়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানায়। সুধী সমাবেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষের সংকুলান হলেও লক্ষাধিক মানুষ বাইরে উদগ্রীব হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন। প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে মাইকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শুনতে পেলেও এক নজর দেখতে না পাওয়ার বেদনা তাদের কষ্ট দেয়। ভোর থেকে রৌমারী, রাজিবপুর, উলিপুর, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ী, ভুরুঙ্গামারী, বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ারছড়া, রাজারহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে এক নজর দেখার জন্য অপেক্ষা করেন।
তারা সভাস্থলে যেতে না পারলেও চিলমারীর শহরের পথে পথে খণ্ড খণ্ড মিছিল করে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানায়। প্রধানমন্ত্রী সোয়া ১২টা থেকে পৌনে ১টা পর্যন্ত প্রায় ৩০ মিনিট ধরে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠান শেষে দুপুর পৌনে ২টার দিকে তিনি হেলিকপ্টারযোগে চিলমারী ত্যাগ করেন।
সারা দেশে ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষকে এ কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে। কুড়িগ্রাম জেলায় মোট ১ লাখ ২৫ হাজার ২৭৯টি পরিবার খাদ্যবান্ধব কার্ডের মাধ্যমে সরকারের সৃজনশীল এই কর্মসূচির সুফল পাবেন। এর মধ্যে চিলমারীতে ৮ হাজার ২১ জন দরিদ্র পরিবারকে এই কার্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া কুড়িগ্রাম সদরে ১৭ হাজার ৭২২টি, নাগেশ্বরীতে ২৪ হাজার ২০টি, ভুরুঙ্গামারীতে ১৩ হাজার ৯৮৫টি, ফুলবাড়ীতে ৯ হাজার ২৯৮টি, রাজারহাটে ১০ হাজার ৬০২টি, উলিপুরে ২৪ হাজার ২০৮টি, রৌমারীতে ১২ হাজার ৬৮৫টি ও রাজীবপুর উপজেলায় ৪ হাজার ৭৩৮টি কার্ড বিতরণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। চাল বিক্রির জন্য জেলায় ২৪৭ জন সম্ভাব্য ডিলারের মধ্যে ১২৬ জনকে ইতিমধ্যে নিযুক্ত করা হয়েছে।
খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপির সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন বিশেষ অতিথি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এমপি, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপি, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি, চিলমারী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও চিলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত আলী সরকার বীরবিক্রম প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব এএম বদরুদ্দোজা।
এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য একেএম মাঈদুল ইসলাম মুকুল, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য রুহুল আমিন, সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি অ্যাডভোকেট সফুরা বেগম, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মো. জাফর আলী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্র কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান, রংপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক অ্যাডভোকেট মমতাজুল হক, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক খান মো. নুরুল আমিন, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ, চিলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুছ সরকার প্রমুখ।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী এমপি ’৭৪-এর চিলমারীর আলোচিত জাল পরা সেই বাসন্তীর কথা উল্লেখ করে বলেন, এটি ছিল একটি ষড়যন্ত্র। কারণ মানসিক প্রতিবন্ধী বাসন্তীকে জাল পরিয়ে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকারকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়। কুচক্রী মহলের সে ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। চিলমারীতে এখন আর মঙ্গা নেই।
সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘মুই বাহে তোমার মানুষ, বাড়ি মোর নীলফামারী।’ মোর হিংসা হয়, এক বছরে প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামে দু’বার আসল। আর আমি গত আট বছরে একবারও নীলফামারীতে নিতে পারি নাই প্রধানমন্ত্রীকে। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রামের মানুষকে ভালোবাসে। মঙ্গা দূর করাই ছিল তার লক্ষ্য। কুড়িগ্রাম তথা রংপুর অঞ্চলের মঙ্গা এখন জাদুঘরে।
সভাপতির বক্তব্যে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি বলেন, বর্তমান সরকারের নেয়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে যোগ হল খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, ক্ষুধা হবে নিরুদ্দেশ।’ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা এমপি বলেন, জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে আজ মঙ্গাকবলিত মানুষের দুঃস্বপ্নের দিন শেষ হয়েছে। তিনি জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু বলে বক্তব্য শেষ করেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.