ফলেন এঞ্জেল’!
এর খুব ভালো কোনো বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভবত নেই, স্বর্গ থেকে পতিত দেবদূত বলে হয়তো কিছুটা বোঝানো সম্ভব। আজ থেকে ঠিক নয় বছর আগে এই দিনে এ রকমই এক ‘ফলেন এঞ্জেল’ নেমে এসেছিলেন জোহানেসবার্গে। যাঁর ব্যাট স্বপ্ন দেখিয়েছিল একটি পুরো দেশকে, অসম্ভবকে সম্ভব করার আশা দেখিয়ে যিনি নায়ক হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু ক্ষণিকের এক ভুলে তিনিই হয়ে গেলেন খলনায়ক, দেশের স্বপ্নভঙ্গের কারণ। তিনি মিসবাহ-উল-হক। বিশ্বকাপ ফাইনাল। মুখোমুখি ভারত-পাকিস্তান। এই দৃশ্য দেখার জন্য অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে ক্রিকেটমোদীদের। ফুটবলে যেমন একটি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ফাইনালের অপেক্ষায় বসে আছেন সবাই। ক্রিকেটে সে অপেক্ষা ফুরিয়েছে ২০০৭ সালে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম আসরেই। অবশ্য ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ ওই টুর্নামেন্টে এর আগেই দেখা হয়ে একবার। একই গ্রুপে ছিল ওই দুই দল। সে ম্যাচটি তো ক্রিকেট ইতিহাসেই আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। ভারতের ১৪১ রান তাড়া করতে নেমে ২০ ওভার শেষে পাকিস্তানও করল ঠিক ১৪১ রান! টাই ম্যাচে ফল আনার জন্য তখন বোল-আউটের নিয়ম চালু ছিল। ২০০৬ সালেই এর প্রয়োগ হয়ে গেলেও বিশ্বকাপে সেটা দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল ওই ম্যাচ। ব্যাটসম্যান বিহীন উইকেটে স্টাম্পে বল করার সে খেলায় পাকিস্তানকে ৩-০–তে হারিয়ে ম্যাচটি জিতে নিয়েছিল ভারত। সেবার প্রায় তরুণ একটা দল নিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েই শেষ পর্যন্ত ফাইনালে উঠে গেল ভারত। চিরপ্রতিদ্বন্দীদের কাছে গ্রুপের ম্যাচে বোল-আউটে হারলেও পরের ম্যাচগুলো দাপটের সঙ্গে জিতেই শেষ পর্যন্ত ফাইলানে ওঠে পাকিস্তানও। ফাইনালের আগেই একটা ধাক্কা খেয়েছিল ভারত দল। কুঁচকির চোট ছিটকে দেয় ব্যাট হাতে ভারতের সবচেয়ে বড় আস্থা বীরেন্দর শেবাগকে। শুধু গৌতম গম্ভীর (৭৫) একাই লড়াই করেছেন, অন্য সব ব্যাটসম্যানই ব্যর্থ ছিলেন ফাইনালে। শেষ দিকে রোহিত শর্মার ১৬ বলে ৩০ রানেই ১৫৭ করে ভারত। ১৫৮ রান তাড়া করতে নেমে পাকিস্তানও খুব ভালো করছিল না। রুদ্র প্রতাপ সিং ও ইরফান পাঠানের বোলিং তোপে ১১.৪ ওভারেই মাত্র ৭৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে পাকিস্তান। এরপর ইয়াসির আরাফাত ও সোহেল তানভীরকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর এক দারুণ গল্প লেখেন মিসবাহ। ৪ ওভারে ৫৮ রানের কঠিন লক্ষ্যকে ১ ওভারে ১৩ রানের সমীকরণে নিয়ে আসেন মিসবাহ। শেষ ওভারে অনভিজ্ঞ যোগিন্দর শর্মার হাতে বল তুলে দিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি। গ্যালারির ভারতীয় দর্শকেরা তাঁর সিদ্ধান্ত দেখে মাথা চুলকাচ্ছেন! অভিজ্ঞ হরভজন সিং কিংবা ১ ওভারে মাত্র ৫ রান দেওয়া ইউসুফ পাঠানকে বাদ দিয়ে মিডিয়াম পেসার যোগিন্দরের হাতে বল তুলে দেওয়ার পেছনে হয়তো একটা কারণই ছিল। ১০ দিন আগের ওই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটি। সেদিনও পাকিস্তানকে কঠিন এক সমীকরণ থেকে জয়ের খুব কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন মিসবাহ। শেষ ওভারে ১২ রান দরকার ছিল সেদিনও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শ্রীশান্তের শেষ ২ বলে ১ রানও নিতে পারেননি মিসবাহ।
ফাইনালেও ৬ বলে ১৩ রানের সমীকরণ। ব্যাটসম্যান ওই মিসবাহ। পেসারদের মধ্যে একমাত্র যোগিন্দরের ওভারই বাকি ছিল, তাঁর হাতেই তাই বল তুলে দিলেন ধোনি। প্রথম বলটাই ওয়াইড। পরের বলটি ডট। এর পরের বলে সোজা বোলারের মাথার ওপর দিয়ে ছক্কা! ৪ বলে দরকার মাত্র ৬ রান। এরই মধ্যে ৪টি ছক্কা মারা মিসবাহর জন্য এ আর এমন কী! ঠিক ওই সময়ই স্কুপ খেলার ইচ্ছে হলো মিসবাহর। কিন্তু টাইমিংয়ের গড়মিল, বল শর্ট লেগে দাঁড়ানো শ্রীশান্তের হাতে! ব্যস, মিসবাহর হাত থেকে ছিটকে পড়ল বিশ্বকাপ। পাকিস্তানি সমর্থকদের উড়তে থাকা স্বপ্নের ডানা ছেঁটে ফেললেন মিসবাহ, মুহূর্তেই স্বর্গ থেকে মর্তে স্থান হলো ‘দেবদূতে’র। বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন দুই বছর পরেই পূরণ হয়েছে পাকিস্তানের। কিন্তু সেই স্কুপের দুঃস্বপ্ন মনে হয় না আজও ভুলতে পেরেছেন মিসবাহ।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.