তেরশ নদীর দেশ বাংলাদেশ। দেশজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব নদী, হাওর-বাঁওড়, জলাশয়ের কল্যাণেই এ জাতিকে বলা হতো মাছে-ভাতে বাঙালি। হতদরিদ্র মানুষেরও দুমুঠো ভাতের সংস্থান হলে পাতে আর কিছু না হোক অন্তত মাছ জুটত। বিশেষ করে নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত বলে সারা বছরই বাজারে খুব সস্তায় পাওয়া যেত সুস্বাদু মাছটি। নদীশাসনের অভাবসহ বিভিন্ন কারণে অনেক নদী মজে যাওয়ায়, প্রতিনিয়ত নদীর পানি দূষণের কারণে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে এসেছে ইলিশের বিচরণক্ষেত্র। উপরন্তু চলেছে জাটকা নিধন। এভাবে চলতে চলতে অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশের দাম। সুখবর এই যে, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ইলিশ সংরণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গত কয়েক বছর ধরে সরকারের নেওয়া নানা পদপে বাস্তবায়িত হওয়ায় হারানো রাজত্ব ফিরে পেতে যাচ্ছে মাছের রাজা ইলিশ। গত দুই বছরে গুণিতক হারে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি খুবই আশাব্যঞ্জক বলে মনে করছেন মৎস্য বিশেষজ্ঞরা।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রধান প্রজনন মৌসুমে ‘মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রম’ বাস্তবায়ন করতে চলতি মৌসুমে ১২০ জন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পর্যবেণ অনুযায়ী, ১০ বছর আগেও দেশের মাত্র ২১টি উপজেলার নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। এখন ইলিশ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ১২৫টি উপজেলার নদীতে। বিশ্বের মোট ইলিশের ৬০ শতাংশই উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশে। বাকি ইলিশ উৎপাদিত হয় প্রধানত ভারত ও মিয়ানমারে। আর দেশের নদীতে ধরা পড়া মোট মাছের ১১ শতাংশই ইলিশ।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এ প্রসঙ্গে আমাদের সময়কে বলেন, জাটকা নিধন রোধে ইলিশধরা জেলেদের জন্য ভিজিএফের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের সময় বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদেেপর ফলে জাটকা মৌসুমে মাছ ধরা অনেক কমে যায়। ফলে গত অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদনও যথেষ্ট বেড়েছে।
মন্ত্রী বলেন, প্রধান প্রজনন মৌসুম ধরে গত বছর আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার দিন এবং এর আগের তিন দিন ও পরের এগারো দিনসহ মোট ১৫ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল। আর এবার আশ্বিন মাসের প্রথম চাঁদের পূর্ণিমার দিন এবং এর আগে চার দিন ও পরের সতের দিনসহ মোট ২২ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময় পার হওয়ার পরও মা ইলিশ সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার পথে ধরা পড়ে। এজন্য গত বছর এই নিষেধাজ্ঞার সময় বাড়িয়ে ১৫ দিন করা হয়। এর পরও মা ইলিশ ধরা পড়ায় এবার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা থাকছে। এ সময়ে ইলিশ ধরা ঠেকাতে অভিযান চালানো হবে। সরকারের নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি অবধারিত বলে হুশিয়ার করেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, জাটকা রা, ভরা প্রজনন মৌসুমে ইলিশ আহরণ বন্ধ এবং ইলিশের ৫টি অঞ্চলকে অভয়াশ্রম ঘোষণাÑ এই তিনটি কাজের মধ্য দিয়েই বর্তমানের ব্যাপক সফলতা মিলেছে। পাশাপাশি জেলেদের প্রতি সরকারের সহায়তা একটি বড় ভূমিকা রেখেছে।
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২-০৩ অর্থবছরে দেশে ২ লাখ টনের কম ইলিশ উৎপাদিত হতো। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে উৎপাদিত হয়েছে ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০০-০১ সালে ২ লাখ ২৯ হাজার ৭১৪ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে। কিন্তু পরের অর্থবছরে উৎপাদন ৯ হাজার ১২১ টন কমে গেছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন আরও কমে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩২ টনে নেমে আসে। এর পর জাটকা রা কর্মসূচিতে জোর দেয় সরকার। এতে উৎপাদন কিছুটা বাড়তে থাকে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৯২১ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এর পর মা-ইলিশ রার কর্মসূচি আরও জোরদার করলে ইলিশের উৎপাদন ৩ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়।
মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ লাখ টনের বেশি ইলিশ উৎপাদন হয়। আর চলতি বছর উৎপাদন সাড়ে ৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা-ইলিশ সুরা ও ডিম পাড়ার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারায় এ ধারাবাহিক সফলতা এসেছে। পাশাপাশি আছে সরকারের জাটকা রা কার্যক্রম, মা-ইলিশ সংরণ কার্যক্রম, ইলিশের অভয়াশ্রম চিহ্নিতকরণ, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানÑ ইত্যাদি সময়োপযোগী কর্মসূচি ইলিশের সংখ্যা বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে। মা-ইলিশ রায় ২০১১ সালে যেখানে এক হাজার ৪৪০টি অভিযান চালানো হয়েছিল, সেখানে ২০১৫ সালে চালানো হয় ৫ হাজার ২০৯টি অভিযান।
দুবছর আগেও খুলনা ও বাগেরহাটের নদ-নদীতে ইলিশের তেমন বিচরণ ছিল না। এবার বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই এ অঞ্চলের ১৪ নদীতে ফের ইলিশের বিচরণ ও আমদানি বেড়েছে। প্রচুর পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েছে বলেশ্বর ও বগি নদীতে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, বিশ্বে প্রতিবছর ৫ লাখ টন ইলিশ আহরিত হয়। এর ৬০ শতাংশই আহরিত হয় বাংলাদেশে। ফলে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে এককভাবে ইলিশের অবদানই প্রায় ১১ শতাংশ। সার্বিক প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় জিডিপিতে এর হিস্যা ১ শতাংশের সমপরিমাণ। গত কয়েক বছর ধরেই দেশে ইলিশের উৎপাদন ৩ থেকে ৪ লাখ টনের মধ্যে ওঠানামা করছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন। তবে ইলিশের গড় উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৩ লাখ টনের মতো। এই হিসাবে প্রচলিত বাজারমূল্যে প্রতি কেজির ন্যূনতম দাম ৬৫০ টাকা ধরা হলে সাড়ে ৩ লাখ টন ইলিশের সার্বিক বাজারমূল্য দাঁড়ায় ২২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এই হিসাবে চলতি মৌসুমে ৭০-৭৫ ভাগ মা ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ায় এর বাজার মূল্য দাঁড়াবে ১৫ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা।
মাছবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশের পর্যবেণ অনুযায়ী, ইলিশ পাওয়া যায় বিশ্বের এমন ১১টি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশের উৎপাদন ক্রমাগত বাড়ছে। বাকি ১০টি দেশেই ইলিশের উৎপাদন কমছে। বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন প্রতি বছর ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। ওয়ার্ল্ড ফিশের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে উৎপাদিত মোট ইলিশের ৬৫ ভাগই বাংলাদেশের। ১৫ শতাংশ ভারত ও ১০ শতাংশ মিয়ানমার এবং অবশিষ্ট ১০ শতাংশ আটলান্টিক, প্রশান্ত ও আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলোয় উৎপন্ন হয়।
নদী গবেষণা কেন্দ্রের এক তথ্যে জানা গেছে, দেশের ১৫টি জেলার ৮৫টি উপজেলা ইলিশ উৎপাদনের ভেতর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে জাটকা রা কর্মসূচি জোরদার করা ও অভয়াশ্রমগুলোয় মা মাছ আহরণ বন্ধ রাখা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৩-০৪ অর্থবছরে নয় ভাগ। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ১০ ভাগ, ২০০৮ সালে ৩৮ ভাগ, ২০০৯ সালে ১৭ ভাগ, ২০১০ সালে ৩৩ ভাগ, ২০১১ সালে ৩৬ ভাগ, ২০১২-১৩ সালে বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৪ ভাগ ২০১৩-১৪ সালে ৫০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, দেশের ১০০টি নদীতে কমবেশি ইলিশ পাওয়া গেলেও ইলিশের প্রজনন ও পরিপক্বতা দণিাঞ্চলের নদীতেই হয়। দেশে মোট উৎপাদিত জাটকার ৬০-৭০ ভাগ দেিণর বিষখালী, পায়রা, আগুনমুখা, বুড়িশ্বর, বলেশ্বর ও কীর্তনখোলা নদী থেকে আহরণ করা হয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল এই ৪ মাসেই মোট জাটকার ৪৫-৬৫ ভাগ নিধন করা হয়।
তবে নানা গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন, ইলিশের পোনা জাটকা অবাধে নিধন এবং ডিমওয়ালা ইলিশসহ নির্বিচারে ইলিশ আহরণই এ মাছের চরম সংকট সৃষ্টির প্রধান কারণ। বিজ্ঞানীরা ইলিশ উন্নয়ন ও সংরণের জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি উদ্ভাবন এবং এর ওপর ভিত্তি করে ইলিশ মাছ রার জন্য সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় পরামর্শ উপস্থাপন করেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী সরকার আইন করে জাটকা মৌসুমে জাটকা নিধন এবং ডিম ছাড়ার দিনগুলোয় ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা বন্ধের নির্দেশ জারি করে। এর পর শুরু হয় জাটকা নিধন বন্ধের অভিযান ও জনসচেতনতা সৃষ্টির পরিকল্পিত কার্যক্রম। জাটকা নিধন ও ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ করা না গেলেও প্রতি বছর ইলিশ আহরণের পরিমাণ বাড়ছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.