মো. জাহিদুল ইসলাম (১৯) ও তামান্না ওরফে সুলতানা (১৫)। তারা সম্পর্কে চাচতো ভাই-বোন। দুজনের পরিবার দীর্ঘদিন ধরে ঢাকায়। কিন্তু আগে তাদের তেমন দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। গত ঈদুল আজহার দু’দিন পর ভোলায় গ্রামের বাড়ি যায় উভয় পরিবার। কাকতালীয়ভাবে নৌকায় দেখা। দুজনের পরস্পরকে ভালো লেগে যায়। সপ্তাহখানেক গ্রামে থাকাকালে বাড়ে প্রেমের ঘনিষ্ঠতা। ঢাকায় আসার পর চলছিল উভয়ের মুঠোফোন কথা। লুকিয়ে দেখা-সাক্ষাৎ। গত সোমবার রাতে প্রেমিকা জাহিদকে ডেকে নেয়। ডেমরায় প্রেমিকার বাসার কাছে কথা বলার সময় ধরা পড়ে যায় জাহিদ। তাকে ধাওয়া দিয়ে ধরে ফেলে প্রেমিকার ভাই মোসলেম ও সহযোগীরা। বাসায় আটকে রেখে তাকে লোহার রড ও লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। চলে এলোপাথাড়ি লাথি, কিল, ঘুষি। প্রায় সারারাত চলে অন্তত ৭ জনের নির্মম নির্যাতন। নির্যাতনের পর হাসপাতালে জাহিদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় গত বুধবার রাতে আটক হয়েছে প্রেমিকার বাসার ভাড়াটিয়া প্যারামেডিক চিকিৎসক নাজমুল আহসান ও তার ছেলে কামরুল। গতকাল তারা রিমান্ডে ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। পুলিশের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছে প্রেমিকা সুলতানাও। সাক্ষ্য দিয়েছেন স্থানীয়রা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডেমরা থানার উপ পরিদর্শক হুমায়ুন কবির মানবজমিনকে বলেছেন, গতকাল শুক্রবারের জিজ্ঞাসাবাদে আটক দুই আসামির মধ্যে একজন ঘটনায় জড়িত থেকে নির্মম নির্যাতনে জাহিদ খুনে অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করেছে। বর্ণনা দিয়েছে নির্মমতার। যে যেভাবে পেরেছে, আটক জাহিদকে তারা আঘাত করেছে। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির জন্য আদালতে পাঠানো হবে। প্রেমিকা সুলতানাও একই বিষয় স্বীকার করেছে। জানা যায়, নিহত জাহিদের বাড়ি ভোলা জেলার লালমোহন থানার কালমা গ্রামে। তার পিতা আবদুল বারেক ২০০১ সাল থেকে ১৫ বছর ধরে ঢাকায় থাকেন। শাহজাদপুরেই তাদের বাসা। তার ছিল তিন ছেলে। সবার বড় মো. রিয়াজ উদ্দিন। দ্বিতীয় ছিল নিহত জাহিদ। সবার ছোট মো. মোশাররফ জয়। আবদুল বারেকের অপর সহোদর আলী আকবর থাকেন মিরপুরে। রাজধানীতে তাদের আরো এক চচাতো ভাই থাকেন। তার নাম ছিদ্দিক হাওলাদার। ডেমরার সারুলিয়ার রানীমোহন সিনেমা হলের কাছে গলাকাটা পুল এলাকায় লিংকনের বাসায় তিনি ভাড়ায় থাকেন। তার তিন ছেলে এক মেয়ে। প্রথম ছেলে মোসলেম, দ্বিতীয় জুবায়ের গাজী, তৃতীয় ছেলে নিশান। আর সবার ছোট তামান্না ওরফে সুলতানা। সে স্থানীয় একটি স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে পড়ছে। এতদিন তাদের সঙ্গে জাহিদের পরিবারের তেমন যোগাযোগও ছিল না। গত ঈদুল আজহায় গ্রামে যাওয়ার সময় দেখা। সেই থেকেই উভয়ের প্রেম। এরই মধ্যে প্রায় মাস খানেক আগে জাহিদ শাহজাদপুরে কর্মরত হার্ডওয়ার দোকানের চাকরিও ছেড়ে দেয়। ১০ দিন আগে জাহিদ আরো একবার সুলতানাদের বাসায় যায়। তখন ফোন করে জাহিদের পিতা ও ভাইকে দ্বিতীয়বার দেখা করার চেষ্টা করলে তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় সুলতানার ভাইয়েরা। গত সোমবার বিকাল ৪টার দিকে জাহিদ বাসা থেকে বের হয়। এর মধ্যে তার সুলতানার সঙ্গে ফোনে কথা হয়। আর সুলতানা তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ডেমরায় যেতে বলে। জাহিদ রাতে তাদের বাসার কাছে যায়। রাতে সে বাসার কাছে সুলতানার সঙ্গে কথা বলার সময় দেখে ফেলেন তার বড় ভাই মোসলেম। এ সময় জাহিদকে তারা ধরে রাস্তায় প্রকাশে কিল, ঘুষি মারে। তার মাথায় লোহার পাইপ দিয়ে আঘাত করা হয়। তাতে মাথা ফেটে যায়। এরপর তাকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সুলতানার পিতা ছিদ্দিক, ভাই মোসলেম, জুবায়ের, নিশান, নাজমুল, তামান্নার দুই মামা ফারুক মাসুদ তাকে দীর্ঘক্ষণ ধরে নির্যাতন করেন। রাত ৩টার দিকে জাহিদের ভাই রিয়াজসহ কয়েকজন তাকে উদ্ধার করতে যান। বাইরে থেকে তালা লাগানো একটি কক্ষে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। দরজা খুলে দেখেন জাহিদ কাতরাচ্ছে। তার গায়ের উপর একটি কাপড় মোড়ানো। রক্তাক্ত দেহ। বাসা থেকে পরে যাওয়া শার্ট-পেন্টও নেই। পরনে লুঙ্গি। এরপর তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎস মৃত ঘোষণা করেন। গত বৃহস্পতিবার ঢামেক মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত হয়। ওই দিন রাতে গাজীপুরের টঙ্গীর তালতলা এলাকায় তার নানার বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। আর এই ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছে সুলতানা পিতা, ভাই ও মামারা। তবে মামলায় সুলতানাকে আসামি না করায় সে তার বাড়িতেই রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তাও তাকে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাননি বলে জানিয়েছেন। নিহত জাহিদের পিতা ও মামলার বাদী আবদুল বারেক বলেন, আমার ছেলে দোষ করে থাকলে চাচা হিসেবে ছিদ্দিককে তার বিচার করতে বলেছিলাম। কিন্তু তাকে এভাবে পিটিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেললো কেন? এখন আমার ছেলেকে সে কী এনে দিতে পারবে? আমি এ হত্যার বিচার চাই। জাহিদের বড় ভাই রিয়াজ বলেন, প্রেম করলে কী তাকে মেরে ফেলতে হবে। দোষ করলে তো আমরা তার বিচার করতে বলেছিলাম। তাকে নির্মমভাবে মারার পর ঘরে তালা দিয়ে আটকে না রেখে হাসপাতালে নিলেও তো সে মারা যেত না। এ কেমন নৃশংসতা?
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.