সব মৃত্যুই চিরতরে চলে যাওয়া নয়। বিশেষ করে কীর্তিমানদের মৃত্যু। এদের শারীরিক উপস্থিতিই কেবল বিলীন হয়ে যায় মৃত্যুর মাধ্যমে। কিন্তু কর্মের বিশালতা এবং ঔজ্জ্বল্য তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখে অনন্তকাল। তেমনই এক কীর্তিমান পৃষ্ঠা ৯ কলাম ১ মানুষ আজিজ মিসির। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্র জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। স্বাধিকার ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রপথিক। আপসহীন লেখনীর এক অনুপম আদর্শ। চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ। দক্ষ সংগঠক। মিশুক প্রকৃতির সংগ্রামী মানুষ। নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক। একাধিক পরিচয়ের অনন্য এ মানুষটি আমাদের মাঝে আর নেই। আজ তার ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০২ সালের এই দিনে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তিনি। সাংবাদিক আজিজ মিসির ১৯৩১ সালে হবিগঞ্জ জেলার সুতাং গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্যপাড়ায়। তার পিতা আবদুর রহিম চাকরি সূত্রে সপরিবারে হবিগঞ্জ অবস্থানকালে সেখানে তিনি জন্ম নেন। ছোটবেলা থেকেই আজিজ মিসির সাহিত্যের নেশায় মেতে থাকতেন। লেখালেখিতে তার হাতেখড়ি কলেজে পড়ার সময়। আজিজ মিসিরের আসল নাম সিরাজুল ইসলাম। কলেজে পড়ার সময় ‘পরিচিতি’ ও ‘সীমান্ত’ নামের দুটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। পাশাপাশি ঢাকা ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত গল্প ও কবিতা লিখতেন। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯৫২ সালে স্নাতক পাস করেন। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বাধিকার আন্দোলন ছিল তার লেখালেখির মূল বিষয়। ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ পত্রিকায় ‘পলিমাটি’ শিরোনামে তার ছোটগল্প প্রকাশ হয়। এ গল্প প্রকাশের পর পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়েন তিনি। সরকারি নির্যাতন থেকে রক্ষার জন্য তিনি কিছুদিন আত্মগোপন করেন। অবশেষে তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন আজিজ মিসির। তখন থেকে আজিজ মিসির নামে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় গল্প-কবিতা লেখার সূত্রেই তিনি ১৯৫৮ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। দীর্ঘ ৪০ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে আজিজ মিসির দৈনিক বাংলার বাণী, সাপ্তাহিক চিত্রালী, দৈনিক বার্তা, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা ও দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় কাজ করেছেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক মানবজমিনে সম্পাদকীয় উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। সাংবাদিকতার পেশাগত উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন সারা জীবন। ১৯৭৩ সালে তিনি ভারতে উন্নয়ন সাংবাদিকতার ওপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সাংবাদিকতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, কবিতা ও নাটক লেখাও অব্যাহত ছিল তার। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের বিশেষ শ্রেণির নাট্যকার ছিলেন। চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্য এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার মনোনয়ন কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রেস কাউন্সিলের সদস্য হিসেবেও একাধিকবার দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার অন্যতম প্রবর্তক আজিজ মিসির চলচ্চিত্রের সার্বিক মানোন্নয়নে সদা তৎপর ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতেন দেশীয় সংস্কৃতি ও কৃষ্টিনির্ভর চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে দেশের চলচ্চিত্র একদিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গনকে সমৃদ্ধ করবে। আর এ জন্য আমাদের চলচ্চিত্রে সমাজ ও রীতিবিরুদ্ধ কোনো কিছু দেখলেই তিনি আপসহীন অবস্থান নিতেন। এ অবস্থানে থেকে ‘আমি’ পরিচয়ে চিত্রালীতে টানা ৩০ বছর লিখেছেন ‘প্রবেশ নিষেধ’ শিরোনামে। সাংবাদিকতার জন্য বিশ্বের বহু দেশও তিনি ভ্রমণ করেছেন। ১৯৭২ সালে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব্ব করেন। ১৯৯০ সালে তিনি ভারত সরকারের আমন্ত্রণে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে যোগ দেন। এছাড়া বিভিন্ন সময় বৃটেন ও আমেরিকা সফর করেছেন। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যিক জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে টেনাসিনাস, বাচসাসসহ একাধিক জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। সেরা নাট্যকার হিসেবে ১৯৮৯ সালে আজিজ মিসির টেনাসিনাস পুরস্কার লাভ করেন। এর আগে তিনি বাচসাস পারভেজ স্মৃতি পুরস্কার, রেইনবো ফিল্ম সোসাইটিজ পুরস্কার, সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ডসহ নানা পুরস্কার লাভ করেন। তার নিজ হাতে গড়া বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি সহ সাংবাদিকদের একাধিক সংগঠন তার জীবন ও কর্মকে চিরজাগরূক করার জন্য প্রবর্তন করেছে আজিজ মিসির স্মৃতিপদক। এ দেশের সমাজ সভ্যতার সোনালি স্বপ্ন নিয়ে তিনি সর্বশেষ লিখেছিলেন ‘বেঁচে থাকার দুরন্ত বাসনায়’। ওই লেখায় তিনি হতাশার পাশাপাশি আশার বাণীও শুনিয়েছেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.