সংসদ সদস্যের পাজেরো, সরকারি বড়কর্তার জিপ, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ওবিভ্যান, পুলিশের টহল গাড়ি আর খুচরো কিছু অটোরিকশা_ বাড়ির সামনের ভিড় ঠেলে উঠানে গিয়ে যখন আবিষ্কার করা হলো বাড়ির একমাত্র ছেলেটিকে, তখন মিষ্টি, ফুল আর সেলফিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে মেহেদি হাসান মিরাজ। ভালোবাসার তীব্রতা থেকে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে বাঁচিয়ে স্কুটারে চড়তে চড়তেই মনের ঝাঁপি খুললেন তিনি। বিস্ময় বালকের মুখ থেকে জানা গেল অনেক অজানা আর মজার কথাও। শহর ঘুরে কখন যে সেই স্কুটার এসে আবারও বাড়ির সামনে থামল, টেরই পাওয়া গেল না। এরই মধ্যে শেষ এক ঘণ্টা।
মিরাজ :তাই নাকি, ১২টা বেজে গেছে! মা সত্যিই মন খারাপ করে আছেন। সকাল থেকে যা মিষ্টি পেটে গেছে, আর জায়গা নেই।
সমকাল :শুধু মিষ্টি, সেলফিও কি কম হলো, স্কুলের বন্ধু থেকে সরকারি অফিসার, কিছু মেয়েও তো এসেছিল।
সবার তো একটাই অনুরোধ_ প্লিজ একটা সেলফি।
মিরাজ :ঠিকই বলেছেন, হঠাৎই নানা মানুষের ভালোবাসা পেলাম। এই পাড়ায় ছোটবেলা থেকে এই ভালোবাসা পেয়েই বড় হয়েছি। তবে কাছের এই চেনা মানুষগুলোও হয়তো কোনোদিন ভাবেনি তাদের মিরাজ সবার প্রিয় হয়ে উঠবে।
সমকাল :তা তো দেখতেই পেলাম। অনেকেই মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে এসেছেন। বাড়িভর্তি লোক, একটু কি মনে হচ্ছে না একা একা খুলনার প্রিয় জায়গাগুলো ঘুরে আসি।
মিরাজ :এটা ঠিক যে, এবার বাড়ি আসাটা একটু অন্যরকম। আগের মতো নয়। একটি সিরিজেই সব যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। আমার বাবা-মায়ের দোয়া আছে। আত্মীয়রা_ বরিশালে সবাই আমার জন্য দোয়া করেছেন। এবার তেমন সময় নিয়ে আসতে পারিনি। পরে এলে অবশ্যই আরও বেশি করে শহরে ঘুরে বেড়াব।
সমকাল :বরিশাল! আপনি তো খুলনার ছেলে। প্রিন্স অব খুলনা।
মিরাজ :ব্যাপারটি ভীষণ মজার। সবাই জানেন আমি খুলনার ছেলে। আসলে আমার বাড়ি বরিশাল_ বরিশাইল্যা আমি। বাকেরগঞ্জ থানার আউলিয়া গ্রামে আমাদের ভিটাবাড়ি। আমার দাদার বাড়ি, নানাবাড়ি সব ওখানেই। এখনও সেখানে আমার চাচারা থাকেন। খুলনায় আমি বেড়ে উঠেছি, এখান থেকেই ক্রিকেটার হয়েছি। খুলনা থেকেই ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত হয়েছি। খুলনাও আমার।
সমকাল :এখন অবশ্য খুলনা-বরিশাল নয়, পুরো দেশই আপনার ঠিকানা।
মিরাজ :ঠিকই বলেছেন, সেদিন টেস্ট জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন। তিনি আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। মায়ের মতো দরদি কণ্ঠে বলেছেন, ঠিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করবে, শরীরের প্রতি যত্ন নেবে। তার একটি কথা দারুণ প্রেরণা দিয়েছে আমাকে। তিনি বলেছেন, তোমরাই একদিন এই বাংলাদেশকে আরও অনেক ওপরে নিয়ে যাবে। তোমাদের অর্জনে পুরো বিশ্বে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াবে। বিশ্বাস করুন, ভীষণ ভালো লেগেছে তার ফোন পেয়ে। তার একটি মাত্র ফোন আমাকে দারুণভাবে উজ্জীবিত করেছে।
সমকাল :মিরাজ, আপনার কোচের সঙ্গে একটু আগে কথা হচ্ছিল। তিনিই শোনাচ্ছিলেন ৮ বছরের একটি বালক এসে একদিন তার একাডেমিতে গিয়ে বলে, স্যার আমি ক্রিকেট খেলতে চাই। আমাকে নেবেন?
মিরাজ :ঠিকই বলেছেন তিনি। আসলে বরিশাল থেকে যখন আমরা খুলনায় আসি, তখন আমার বয়স ৫ কি ৬ বছর। বরিশালে চাচাদের সঙ্গে নিজেরা মিলে ক্রিকেট খেলতাম। মনে আছে সেই দিনগুলো, ক্ষেত থেকে ধান তোলার পর কিছুটা জায়গায় পিচ বানিয়ে ক্রিকেট খেলতাম রাজীব, রুবেল আর মামুন চাচা মিলে। তখন টেপ টেনিস কিংবা মারুতি বল দিয়েই ক্রিকেট খেলতাম। খুলনায় আসার পরই প্রথম ক্রিকেট বল হাতে নিই। তখন আমার বয়স ১১ কি ১২। এই বিএল কলেজের পাশেই কাশিপুর ক্রিকেট একাডেমিতে।
সমকাল :চাচাদের সঙ্গে ধানক্ষেতের ওই পিচটাও কি স্পিনিং ছিল?
মিরাজ :পিচ কী জিনিস সেটাই তো তখন জানি না।
সমকাল :তাহলে বরিশাল থেকে আসার পর খুলনার এই একাডেমিতেই ক্রিকেটের হাতেখড়ি?
মিরাজ :একদম তাই। এখানে প্রথম স্থানীয় একাডেমির টুর্নামেন্ট। তারপর জেলা দল, বিভাগীয় দল হয়ে প্রথম ঢাকায় যাওয়া।
সমকাল :ছোট্ট করে বললেন, তবে যাত্রাটা নিশ্চয় এত সহজ ছিল না। শুনেছি ক্রিকেট খেলার জন্য বাবা খুব বকাঝকা করতেন। কখনও কখনও পিঠেও পড়ত দু-চারটা…।
মিরাজ :ঠিকই শুনেছেন। যখন ক্রিকেট মাঠে যেতাম, তখন আব্বু খুব বকাঝকা করতেন। সাপোর্ট পেতাম না। আব্বু হয়তো ভেবেছিলেন, ছেলে পড়ালেখা করে চাকরিবাকরি করবে। সব অভিভাবকের এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু আমাকে ক্রিকেট টানত। শুধুই ক্রিকেট। বিএল কলেজের মাঠে কিছু দিন অনুশীলন করার পর দিন চারেক যেতে পারিনি। ওই সময় একটি ম্যাচ খেলতে পারিনি আমি। ভীষণ মন খারাপ হয়েছিল। কোচও মনে হয় কিছুটা রাগ হয়েছিলেন। তাই পরের দিন গিয়ে ম্যাচের সময় লাঞ্চটাঞ্চ এগিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর স্যার পরের ম্যাচে আমাকে খেলার সুযোগ করে দেন।
সমকাল :কিন্তু আপনার আব্বুকে দেখে তো এত কড়া মনে হয় না এখন।
মিরাজ :আসলে আব্বুর তখন ক্রিকেট সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। তিনি মনে করতেন ক্রিকেট খেললে, এদিক-সেদিক গিয়ে যার-তার সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে যাব আমি। তবে পরে যখন বাংলাদেশ বয়সভিত্তিক দলে চান্স পেলাম, টিভিতে আমার খেলা দেখাত, তখন আব্বু একটু একটু করে ক্রিকেট বুঝতে থাকেন। বকাঝকাও কমে যায়।
সমকাল :বকাঝকার সঙ্গে তো মারধরও চলত, পাশের এক চা দোকানিই বলছিলেন তা।
মিরাজ :আসলে যেমনটা হয় আর কি ছোটবেলায়। একটু-আধটু মারধর তো খেতে হতোই। তবে মা সব সময় আমাকে স্নেহের আঁচলে আগলে রাখতেন। আম্মু কখনও আমাকে মারেননি। তবে আব্বু যখন খুব বেশি মারধর করতেন, তখন মনে হতো পালিয়ে চলে যাব অন্য জায়গায়। থাকব না এখানে, চলে যাব। একবার রাগ করে বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। সন্ধ্যায়ও ফিরিনি দেখে বোনকে নিয়ে মাঠে খুঁজতে গিয়েছিলেন মা। আব্বুও পুরো পাড়ায় খুঁজেছেন আমাকে। যখন পাচ্ছিলেন না, তখন আব্বুর সে কী কান্না। পরে আমি বাসায় ফিরে আসি।
সমকাল :মিরাজ, আপনার বাড়িতে আসার পর ভিড়ের মধ্যেই অনেকে বলাবলি করছিল, মিরাজের এখন অনেক টাকা, সিরিজ জিতে কত টাকা পেয়েছে জানিস …।
মিরাজ :হাসি, আসলে মানুষ টিভিতে আমাকে পুরস্কার নিতে দেখেছে তো তাই। মনে আছে, প্রথম যেদিন আমি ক্রিকেট খেলে টাকা পাই, সেদিনের কথা। জেলা দলের হয়ে খেলে ৫০ টাকার একটি নোট পেয়েছিলাম। সেটাই আমার প্রথম রোজগার। বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে তুলে দিই তা, ৩০০ টাকা জমিয়ে ছিলাম ওই সময়। আমার মা খুব সহজ-সরল। তিনি শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই টাকা কোথায় পেলি। ক্রিকেট খেলে_ শুনে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। অশ্রুতে ভিজে উঠেছিল মায়ের দুটি স্নেহভরা চোখ।
সমকাল :মিরাজ, ‘লোকে বলে’ একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
মিরাজ :লোকে কী বলে?
সমকাল :অনেকের কৌতূহল আপনার ভাড়া বাড়ির পাশে বড় বড় দুটি বিল্ডিং, আপনারটা কবে হবে?
মিরাজ :দেখুন, আমি কখনোই অন্য মানুষকে দেখে হিংসা করি না। আফসোস করি না, যা আমার নেই। সব সময় আল্লাহর কাছে এটাই বলি, তুমি আমাকে অনেক ভালো রেখেছ। যা দিয়েছ তাতেই আমি ভীষণ ভীষণ খুশি। এই যে আমার দুটি হাত আছে, পা আছে, চোখ আছে। আমার বাবা আছেন, মা আছেন, বোন আছে। আমি এই পরিবার নিয়েই সুখী। সব সময় চেষ্টা করি মানুষের উপকার করতে, সাহায্য করতে। আমার জন্য কারও ক্ষতি হয় এমনটা আমি কখনোই করি না। আমি কাউকে ঈর্ষা করি না।
সমকাল :আচ্ছা মিরাজ, আজ এই যে আপনার বাড়িতে এত লোক, এত শুভেচ্ছা, কাউকে কি মিস করেন এই ভিড়ের মধ্যে?
মিরাজ :জানেন, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি কী? আমার এক দাদা ছিলেন বরিশালে। খুব ভালোবাসতেন আমাকে। আমি যখন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলতে ভারতে যাই, তখন তিনি মারা যান। আজ আমার এই যে সম্মান, এই যে দেশের সবাই মেহেদি মিরাজ, মেহেদি মিরাজ বলছে, তা যদি একবারও আমার ওই দাদা শুনে যেতে পারতেন, ভীষণ খুশি হতেন তিনি। আজ তিনি বেঁচে থাকলে গ্রামে চেঁচিয়ে বলতেন, এই দেখ আমার নাতি, আমার নাতি এখন বাংলাদেশের হয়ে খেলছে। দাদা বাকেরগঞ্জের গ্রামে থাকতেন, সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না, চাচাদের বাসায় টেলিভিশনও ছিল না। আমার খেলা যখন টিভিতে দেখাত, তখন তিনি অনেক দূর হেঁটে গিয়ে টেলিভিশনের সামনে বসে বলতেন, দেখ আমার নাতির খেলা দেখাবে। আমার দাদার নাম ছিল দেনসের আলী তালুকদার, দাদা … তোমাকে আজ খুব মনে পড়ছে। তুমি কি দেখতে পাচ্ছ আজ আমাকে …।
সমকাল :মিরাজ, এবার একটু আপনার আরেক পরিবার, বাংলাদেশ দলের কথা শুনি। ড্রেসিংরুমে সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য আপনি। বড় ভাইদের মধ্যে কে বেশি আগলে রাখেন।
মিরাজ :দেখুন, আমি বাংলাদেশ ড্রেসিংরুমের সবচেয়ে ছোট। সবাই আদর করে আমাকে। বিশেষ করে মুশফিক ভাই আমাকে ভীষণ সাহস জুগিয়েছেন।
সমকাল :এই যে ইংল্যান্ডের এতগুলো উইকেট শিকার করলেন, দিন শেষে হোটেলে ফিরে যখন ইংলিশদের সঙ্গে দেখা হতো, তখন ওদের মুখগুলো নিশ্চয় শুকনো থাকত।
মিরাজ :মোটেই না, বরং ওরা আমাকে দেখলেই এগিয়ে এসে কথা বলত। সেলফি তুলত।
সমকাল :ওরাও সেলফি তুলেছে?
মিরাজ :হ্যাঁ, অ্যালিস্টার কুক, জো রুট, হামিদ হাসিব সবাই ছবি তুলেছে। হোটেলের লবিতে ওদের সঙ্গে দেখা হতো, হলেই বলত, তুমি খুব ভালো বোলিং করছে। এগিয়ে যাও। অনেক সাপোর্ট করেছে ওরা।
সমকাল :ইংল্যান্ড সিরিজটা যদি আপনার মাইলফলক হয়, তবে ক্রিকেট ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল কী?
মিরাজ :অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় দল থেকে বাদ পড়া। ২০০৯ সালে, তার আগের দু’বছর আমি অনূর্ধ্ব-১৫ জাতীয় দলে খেলেছি। কিন্তু ওইবার আমার বয়স ১৪ থাকা সত্ত্বেও বাদ পড়ে যাই ওই দল থেকে। অনেক কান্নাকাটি করেছিলাম বিকেএসপিতে বসে। তখন ওই দলে তাসকিন, আবু হায়দার রনিরাও ছিল। দলের প্রধান কোচ ছিলেন দীপু রায় চৌধুরী। নির্বাচক ছিলেন সিজান ভাই। তারা দু’জনেই আমাকে বলেন, মন খারাপ করো না, তোমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে বয়সের কারণে, পারফরম্যান্সের জন্য নয়। তবু আমার মন মানছিল না, দীপু স্যার এরপর বিসিবিতে গিয়ে আমার বয়স নিয়ে অনেক লড়াই করলেন। তার পরই আমাকে ওই দলে নেওয়া হয়। মনে আছে, পরের বছর আমি ওই দলের অধিনায়ক হয়ে পশ্চিমবঙ্গ সফর করি। তার পরের বছর অনূর্ধ্ব-১৭ এবং তার পরের বছর অনূর্ধ্ব-১৯। আমার কাছে মনে হয়, সেদিন ওই অনূর্ধ্ব-১৫ দল থেকে বাদ পড়া এবং আবার দলে ঢোকাই ছিল আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট।
সমকাল :ইংল্যান্ড সিরিজে স্পিন ট্র্যাকে দারুণ করেছে মেহেদি মিরাজ, পরের চ্যালেঞ্জটা তো নিউজিল্যান্ডে। সে জন্য কি মিরাজ তৈরি?
মিরাজ :ঘরের মাঠে স্পিনিং উইকেট ছিল, তার একটা সুবিধা পেয়েছি। তবে নিউজিল্যান্ডে তো সিমিং কন্ডিশন, তার জন্য আমাকে আরও স্কিল বাড়াতে হবে। মানসিকভাবে আরও শক্ত থাকতে হবে। ধৈর্য সহকারে খেলতে হবে সেখানে। সেখানে উইকেট পাওয়া হয়তো একটু কঠিন হবে, তবে আমি আশাবাদী। আমাকে অনেক কিছু এখনও শিখতে হবে। আজ এখানেই থাক। ঢাকা ফিরে আরও অনেক কথা বলা যাবে।
( সমকাল থেকে সংগৃহীত )
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.