এবার বড় ধরনের আর্থিক অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অথচ ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম রোধ ও শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব এ প্রতিষ্ঠানটির ওপর। নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা প্রেরণা বোনাস পাবেন মূল বেতনের আড়াইগুণ। সেখানে দেয়া হয়েছে পাঁচগুণ হারে। এভাবে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, ভ্রমণ ভাতা, চিকিৎসা ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে নিয়ম-বহির্ভূত ব্যয় করে শতাধিক কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গুরুতর এ অনিয়মে আপত্তি জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, এ ধরনের ব্যয় করার আইনগত এখতিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক অনিয়ম স্বীকার না করে উল্টো দাবি করেছে, পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়েই এসব ব্যয় করা হয়েছে। এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টানাপড়েন শুরু হয়েছে। এদিকে মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের দফতরও বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ধরনের ব্যয় নিয়ম-বহির্ভূত। এতে গত কয়েক বছরে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ১০৭ কোটি টাকা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
১৭ অক্টোবর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে মতামত চেয়ে অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদকে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মূল বেতনের আড়াইগুণ, চারগুণ ও পাঁচগুণ হারে প্রেরণা বোনাস, দেড়গুণ হারে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, সিলিংয়ের ঊর্ধ্বে চিকিৎসা ভাতা, ভ্রমণ ও দৈনিক ভাতা এবং শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রাপ্যতার হার নির্ধারণে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে কিনা তা জানতে চাওয়া হয়।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. ইউনুসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অতিরিক্ত বেতন-ভাতার নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ ব্যয়ের আইনগত দিক পর্যালোচনা করা হচ্ছে। মতামত চাওয়া হয়েছে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ বিভাগের কাছে। এখন পর্যন্ত তা পাওয়া যায়নি। মতামত পেলেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভংকর সাহা যুগান্তরকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে বেশ কিছুদিন ধরে মূল বেতনের সমতুল্য অতিরিক্ত একটি বোনাস দেয়া হচ্ছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। বিগত সময়ের বোনাস ও ভাতা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আপত্তির বিষয়টি জানা নেই।
সূত্র জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রেরণা বোনাস বাবদ মূল বেতনের আড়াইগুণ দেয়ার বিধান রয়েছে। সেখানে দেয়া হয়েছে পাঁচগুণ হারে। এতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয় ৪৪ কোটি টাকা। জাতীয় বেতন স্কেলের বিধান মতে, অর্থ বিভাগের অনুমোদন ছাড়া বেতন-ভাতা গ্রহণ আইনগত নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো অনুমতি গ্রহণ করেনি অর্থ বিভাগের। তবে এই আর্থিক ব্যয়ের পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সর্বোচ্চ মুনাফা হলে পরিচালক পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে বিধিবিধান সাপেক্ষে প্রেরণা বোনাস গ্রহণ করতে পারে।
সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মূল বেতনের দেড়গুণ হারে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা দেয়া হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রাপ্য নয়, এরপরও তাদের দেয়া হয় এ ধরনের ভাতা। এ খাতে অতিরিক্ত ৬ কোটি টাকা খরচ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন গ্রহণ করে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা নেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী বেতনের সঙ্গে নিয়মিত চিকিৎসা ভাতা গ্রহণ করে আসছেন। এরপরও অসুস্থতার অজুহাতে ঢালাওভাবে চিকিৎসার বিল দেয়া হয় ব্যাংকের তহবিল থেকে। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিয়মিতভাবে চিকিৎসা বিল পরিশোধ করা হয়।
এক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নেয়ার আইনগত বিধান থাকলেও তা পালন করা হয়নি। এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাড়তি খরচ হয় ১২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে এই ব্যয়ের যৌক্তিকতা দেখিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক স্টাফ রেগুলেশনের ৮৪ ধারা অনুযায়ী মেডিকেল এটেনডেন্স রুলস ১৯৭৫ এবং ১৯৮৯ সালের প্রশাসনিক পরিপত্র অনুসারে চিকিৎসা খাতে ব্যয় পুনঃভরণ করতে পারে।
এদিকে প্রাপ্যতার চেয়ে চাকরিজীবীদের অতিরিক্ত ৮ কোটি ৬২ লাখ টাকা ভ্রমণ ও দৈনিক ভাতা দেয়া হয়েছে। নিয়ম হচ্ছে অর্থ বিভাগের পূর্বানুমতি ছাড়া ভ্রমণের সময় এ ধরনের ভাতা অর্ধেকের বেশি গ্রহণ করা যায় না। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন গ্রহণ না করেই বেশি অংকের ভাতা উত্তোলন করা হয়েছে। এই ভ্রমণ ভাতা ব্যয়ের সপক্ষে সাফাই গেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ (সংশোধিত ২০০৩) এবং ৮২(২)(ই) ধারা মোতাবেক ভ্রমণ ও দৈনিক ভাতা গ্রহণ করা হয়েছে।
এদিকে, শুধু বোনাস ও ভাতার নামে ৭১ কোটি ২৫ লাখ টাকা খরচ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ৪৫ লাখ টাকার রাজস্ব স্ট্যাম্প ক্রয়সহ অন্যান্য খাতে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে অর্থ ব্যয় করা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকের ভাড়াকৃত আবাসিক হোটেলের গ্যাস ও বিদ্যুৎ বিল ব্যাংকের তহবিল থেকে পরিশোধ করা হয়। এ ছাড়া সরকারের নির্ধারিত হার অপেক্ষা হ্রাস মূল্যে ডরমেটরি ভাড়া আদায় করা হয়।
জানা গেছে, ব্যাংকের তহবিল থেকে এই রাজস্ব স্ট্যাম্প প্যাড ক্রয় করা হয়। এসব স্ট্যাম্প প্যাড ব্যবহার করা হয়েছে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন দেয়ার সময়। কিন্তু স্ট্যাম্প প্যাড ১৮৯৯ তফসিল-১-এর অ্যাক্ট ৫৩ এবং আইআরডি নির্দেশ অনুসারে বেতন-ভাতার সঙ্গে স্ট্যাম্প প্যাড ব্যবহারের অনুশাসন রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংকটির ১৯৭২ সালের আইনের (সংশোধিত ২০০৩) ৮৪(২) ধারায় ‘রাজস্ব স্ট্যাম্প প্যাড স্থগিত করা হয়েছে’। এ পর্যায়ে ব্যাংক তহবিল থেকে রাজস্ব স্ট্যাম্প কিনে বেতন-ভাতা খাতে ব্যবহার করা যায় কিনা এ বিষয়ে এনবিআরের কাছে মতামত চায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। অতিরিক্ত এই অর্থ ব্যয়ের বিষয় নিয়ে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হলেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি।
জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই অস্বাভাবিক ও নিয়ম-বহির্ভূত ব্যয়ের ওপর অডিট আপত্তি দিয়েছে বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরও। যোগাযোগ করলে বাণিজ্যিক অডিট অধিদফতরের পরিচালক শহিদুর রহমান চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, বেতন স্কেল বিধি-বিধান মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কর্মরতদের অতিরিক্ত বোনাস ও ভাতা প্রদানের কোনো সুযোগ নেই। আইন ও নিয়ম লংঘনের কারণে এ ব্যাপারে আপত্তি দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে একটি বৈঠক হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.