দুই প্রার্থীই শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ওহাইও অঙ্গরাজ্যে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারে উপস্থিত থাকলে হিলারি ক্লিনটনকে ধরা যাবে না। শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প আসার আগেই তাঁর প্রচার ভেন্যু ওয়েলমিংটন ঘুরে চলে যেতে হলো ক্লিভল্যান্ডে। ওয়েলমিংটনে দলে দলে ‘হোয়াইট আমেরিকান’কে প্রচারস্থলে ছুটতে দেখা গেল। কিন্তু ক্লিভল্যান্ডের চিত্র একেবারে আলাদা। হলঘরের বাইরে সমবেত শত শত মানুষের মধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ বেশি। আছেন কিছু শ্বেতাঙ্গ আর এশীয় বংশোদ্ভূতও। ই-মেইল নিয়ে এফবিআইয়ের নতুন তদন্তের উদ্যোগ, ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে মধ্যপ্রাচ্যের অর্থায়ন নিয়ে নানা প্রশ্নের মধ্যে হিলারি ক্লিনটনের কালকের জনসভাটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্লিভল্যান্ডে পৌঁছে আবারও ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান ডেভিড পেপারের কথা মনে হলো। তিনি বলছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সৌন্দর্য হলো এর বৈচিত্র্য। সে জন্যই আমরা বলছি স্ট্রংগার টুগেদার।’ হিলারিও আবার একই কথা বললেন। তাঁর বক্তৃতা ছিল মাত্র সাড়ে ছয় মিনিটের। এর মধ্যে একবারের জন্যও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের নাম উচ্চারণ করেননি। হিলারি বললেন, ‘মার্টিন লুথার কিং উঠে দাঁড়িয়েছিলেন বলে ওবামা দৌড়াতে পেরেছেন। ওবামা দৌড়াতে পেরেছেন বলেই কালো শিশুরা এখন ওড়ার স্বপ্ন দেখে।’
সত্যি বলতে কি, হিলারির গতকাল বেশি কথা বলার আদতে কোনো প্রয়োজনই পড়েনি। যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় র্যাপার জেসিজে হিলারির পক্ষে কনসার্ট করতে আসছেন—এই খবরে এমনিতেই শত শত লোক জড়ো হয়েছিলেন। দু-আড়াই ঘণ্টা ধরে জেসিজে, চ্যান্স দ্য র্যাপার ও বিগ সিয়েন গানের ফাঁকে ফাঁকে হিলারির প্রতি তাঁদের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। তবে তুমুল জনপ্রিয় গ্র্যামি বিজয়ী শিল্পী বিয়ন্স যে আসছেন, তা একরকম চেপেই রেখেছিলেন আয়োজকেরা। বিয়ন্স মঞ্চে ওঠেন সবার পর। গান তো গেয়েছেনই, কেন হিলারিকে ভোট দিতে হবে, সে সম্পর্কেও নিজের ভাবনার কথা বলেছেন। ‘আপনি যে-ই হোন না কেন—শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, মেক্সিকান, এশীয় বা মুসলিম—তাতে কিছুই যায় আসে না। আমার ভাইপো এক মেধাবী কৃষ্ণাঙ্গ। সে একজন আফ্রিকান আমেরিকানকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পেয়েছে। আমি এটা ভেবে উজ্জীবিত হই। আমি চাই, আমার মেয়ে দেখুক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট একজন নারী। সে বিশ্বাস করুক, সবার জন্যই এখানে অপার সম্ভাবনা,’ বলেন বিয়ন্স। স্বামী জেসিজের সঙ্গে তাঁর দ্বৈত পরিবেশনার পর মঞ্চে ওঠেন হিলারি। তখন মিলনায়তনের সব তরুণ ভোটার দাঁড়িয়ে, চিৎকার করে হিলারির প্রতি তাঁদের সমর্থনের কথা জানান।
তার মানে কি এই যে, হিলারি সবার সমর্থন পেয়ে গেলেন? বিষয়টি অত সোজা নয় বলেই মনে হলো। মিলনায়তনে ঢোকার মুখে খাবার কিনতে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনেকে। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বললেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জাতিবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী কথায় তাঁরা আহত। এমনিতেই তাঁরা ডেমোক্র্যাট পার্টির সমর্থক, তবে প্রার্থী যে খুব পছন্দ হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। একজন নারী বলেন, ‘প্রাইমারিতে আফ্রিকান আমেরিকান একজন চিকিৎসক ছিলেন। তাঁকে অনেক বিবেচক মনে হয়েছিল। মনোনয়ন পাননি। কিন্তু তাই বলে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারি না।’
হিলারিকে ঘিরে ওয়েলমিংটনে তরুণ ভোটারদের যে উন্মাদনা, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনসভায় দৃশ্যত ছবিটা সে রকম ছিল না। টিভিতে দেখা গেল, ট্রাম্প তাঁর সমাবেশে হিলারির কড়া সমালোচনা করেছেন। ট্রাম্প বলেন, ‘আমার জেলো, জেসিজে কাউকে লাগে না। আমি আমিই। গিটার লাগে না। আমার গিটার বা পিয়ানো—কোনোটারই দরকার নেই।’
নানা কারণে সমালোচিত ট্রাম্পের সঙ্গ এড়িয়ে চলছেন নিজের দলেরই অনেক নেতা। তিনি মূলত প্রচার চালাচ্ছেন তাঁর স্ত্রী-পুত্র, কন্যাকে নিয়ে। কোনো বিষয়েই খুব পরিষ্কার করে কিছু বলছেন না। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রে আসা ২৫ সাংবাদিকের চারজন ট্রাম্পের সমাবেশে থেকে গিয়েছিলেন। তাঁদের একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যানাবেল ডিকসন পরে বলছিলেন, ‘ট্রাম্প খুব অদ্ভুত। সমাবেশে বলেছেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির জন্য রাখা টাকা দিয়ে আমরা রাস্তা বানাব, রাস্তা না হলে সেতু বানাব। কী বলেন”?’
ট্রাম্পের সমাবেশে অবশ্য উপস্থিতি কম ছিল না। বেলা আড়াইটার দিকে ওয়েলমিংটনের সমাবেশস্থলের কাছে আসছিলেন বৃদ্ধা ডটি থম্পসন। ৭২ বছরের এই নারী বলেন, ‘সত্যি বলতে, ট্রাম্পকে আমি পছন্দ করি না। কিন্তু তিনি গর্ভপাতবিরোধী বলে আমি তাঁকে সমর্থন করি।’ কথা হয় কাইল কক্স ও মেলিসা কক্স দম্পতির সঙ্গে। কাইল ডেমোক্র্যাট সমর্থক ছিলেন। এবার ট্রাম্পকে ভোট দিচ্ছেন। সমর্থন পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে বললেন, ‘বেনগাজিতে চারজন মার্কিন নিহত হওয়ার পর হিলারি যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছিলেন, সেটা ভালো লাগেনি। সেদিন টিভিতে দেখছিলাম, নৌবাহিনীর এক সদস্য সাবমেরিনের যে অংশে কাজ করেন, সে জায়গার ছবি দেওয়ায় এক বছর ধরে জেল খাটছেন। তার চেয়েও বড় অপরাধ হিলারি করেছেন এবং এখন তিনি প্রেসিডেন্ট হতে চাইছেন।’ কাইলের স্ত্রী মেলিসার পছন্দ হয়েছে ট্রাম্পের মেক্সিকো সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণের বিষয়টি। মেলিসা বললেন, তাঁর ছেলে মাদকাসক্ত। মাদক নিয়ন্ত্রণে ওবামা প্রশাসন কিছুই করেনি বলে অভিযোগ করলেন। এবারই প্রথম ভোট দিচ্ছেন চার্লস রাইস। তিনি হিলারির ই-মেইল কেলেঙ্কারি ও ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে সৌদিদের অর্থায়ন নিয়ে বিরক্ত। সে কারণে ট্রাম্পকে ভোট দিতে পারেন। কমপক্ষে চারজন শ্বেতাঙ্গ বলেছেন, ট্রাম্প উল্টোপাল্টা বলে ফেলেন। কারণ, তিনি সাধারণ মানুষের মতো। প্যাঁচগোজ বোঝেন না।
এই শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর কর্মজীবী শ্রেণি ট্রাম্পের সমর্থনের একটা বড় ভিত্তি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.