প্রতিযোগিতাটি স্মার্টফোনের অ্যাপ তৈরির। অংশ নিয়েছেন দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ইএটিএল-প্রথম আলো অ্যাপস প্রতিযোগিতা ২০১৬-এর বুটক্যাম্প গত শনিবার বসেছিল রাজধানীর মিরপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে।
বাইরে তখন বেশ রোদ, তাপমাত্রা বাড়ছে। অনুষ্ঠান শুরুর নির্ধারিত সময় সকাল ১০টা সবে পেরিয়েছে। প্রবেশদ্বারে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুটা তাড়াহুড়া ছিল। রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোর স্টেডিয়ামে ঢুকতে চান তাঁরা। ততক্ষণে অবশ্য স্টেডিয়ামের গ্যালারির দুই-তৃতীয়াংশ আসন শিক্ষার্থীদের দখলে। ১২ নভেম্বরের ঘটনা এটি। এই শিক্ষার্থীরা স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে আসেননি। এসেছিলেন ইএটিএল-প্রথম আলো অ্যাপস প্রতিযোগিতা ২০১৬-এর বুটক্যাম্পে। সেখানে প্রতিযোগিতার প্রতিযোগী যেমন ছিলেন, ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও যোগ দিয়েছেন তাতে। কী উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছিলেন তাঁরা? আয়োজক প্রতিষ্ঠান এথিকস অ্যাডভান্সড টেকনোলজিস লিমিটেডের (ইএটিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ মুবিন খান বললেন সে কথা—‘প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের অ্যাপ নিয়ে কোনো ধরনের দুর্বলতা যেন না থাকে, বুটক্যাম্প আয়োজনের উদ্দেশ্যই তা-ই।’ জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। পরিবেশনায় ছিলেন সুরের ধারার শিল্পীরা। এরপর অনুষ্ঠানে আসা অতিথিরা বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশে অ্যাপ তৈরির সম্ভাবনার কথা শোনান। আয়োজকদের পক্ষে স্বাগত বক্তৃতা দেন ইএটিএল-প্রথম আলো অ্যাপস প্রতিযোগিতার বিচারকমণ্ডলীর সমন্বয়ক রাজেশ পালিত। এরপরেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান তাঁর বক্তৃতা শেষে দিনব্যাপী বুটক্যাম্পের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।
নানা অধিবেশনে ছিল কারিগরি আলোচনা এদিকে সূর্য মধ্যগগনে পৌঁছেছে। রোদ বেশ চড়া। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত স্টেডিয়ামের ভেতরে অবশ্য তা বোঝার উপায় নেই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে শুরু হয় প্রতিযোগীদের জন্য নানা অধিবেশন। অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ লাইফ সাইকেল, গেম ডিজাইন, ইউএক্স অ্যান্ড ইউআই, হাইব্রিড মোবাইল অ্যাপস ইন প্রোডাকশন, অ্যাপ ব্যাকএন্ড, মনিটাইজেশন ও অ্যান্ড্রয়েড পুশ নোটিফিকেশন নিয়ে আলোচনা চলে তাতে। অধিবেশনগুলোতে অ্যাপের কারিগরি নানা দিক প্রাধান্য পায়। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশে গুগলের কান্ট্রি মার্কেটিং কনসালট্যান্ট হাশমী রাফসানজানি, গোল্ডেন ফ্রগের জ্যেষ্ঠ অ্যান্ড্রয়েড প্রকৌশলী রাকিব-উল-আলম, প্রথম আলো ডিজিটালের ব্যবস্থাপক (ডিজিটাল বিক্রয়) স্টিভ অ্যান্থনী জ্যাকব, রাজেশ পালিতসহ অনেকে। অধিবেশনগুলোর ফাঁকে ফাঁকে প্রতিযোগীদের অনুপ্রেরণামূলক কথা শোনান বেসিসের সভাপতি মোস্তাফা জব্বার, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ ও প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক মুনির হাসান। একঘেয়েমি যেন চলে না আসে তাই অধিবেশন আর অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতার মাঝে মাঝে বিরতি ছিল। এমনই এক বিরতিতে কথা হয় রাজশাহীর বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের (সিএসই) ছাত্র মো. খালিদ সাইফুল্লাহর সঙ্গে। তিনি ও তাঁর তিন বন্ধু মিলে অংশ নিয়েছেন অ্যাপ তৈরির এই প্রতিযোগিতায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি করতে পারলে বয়স অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ক্যালরির হিসাব জানাবে সে অ্যাপ। পাশাপাশি জানাবে কী কী খেলে ক্যালরি বাড়বে এবং দিনে কতক্ষণ শারীরিক অনুশীলন করতে হবে। খালিদ বলেন, মূলত স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের লক্ষ্য করেই আমাদের এই অ্যাপ। এ ধরনের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের তুলে ধরা যায়। অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়, এগিয়ে যাওয়ার সাহস সঞ্চয় হয়। অনেকে একাধিক ধারণাও জমা দিয়েছেন। তিন বন্ধুর সঙ্গে অ্যাপ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন মো. আবরার মাসুম। তাঁরা সবাই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। দলের নাম দিয়েছেন বুয়েট ভার্টিক্যাল। দুই বিভাগে দুটি অ্যাপের ধারণাপত্র জমা দিয়েছেন তাঁরা। একটি অ্যাপের নাম দিয়েছেন ‘মিউজিক গুরু’, অপরটির নাম ‘কলার টুলস অ্যান্ড ব্লকার’। মিউজিক গুরুতে গান শোনা যাবে। নিবন্ধন করে ব্যবহার করতে হবে, শ্রোতাদের মধ্যে একধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবস্থা থাকবে এই অ্যাপে।
কয়েক পর্বে চলবে প্রতিযোগিতা ইএটিএল-প্রথম আলো আয়োজিত এই প্রতিযোগিতা চতুর্থবারের মতো শুরু হয়েছে গত ২৪ মে। এরপর সারা দেশের প্রায় ১০০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচারণা চালানো হয়। একই সঙ্গে চলে অ্যাকটিভেশন পর্বও। পরবর্তী ধাপে সারা দেশ থেকে প্রাথমিকভাবে জমা পড়া ধারণাপত্রের মধ্য থেকে ৫০০টি ধারণাপত্র নির্বাচন করা হয় গত ২৪ সেপ্টেম্বর। শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে এসব ধারণাপত্র জমা দেন। ১২ নভেম্বর হলো প্রতিযোগিতার বুটক্যাম্প। চলতি নভেম্বর মাসের ২৫ ও ২৬ তারিখে নির্বাচিত প্রতিযোগীরা বিচারকদের সামনে নিজেদের ধারণাপত্র উপস্থাপন করবেন। এভাবে বিভিন্ন পর্বে এগোবে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতায় সেরা অ্যাপের জন্য রয়েছে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার। এ ছাড়া তিনটি বিভাগের প্রথম অ্যাপ পাবে দুই লাখ করে টাকা। এবারের আয়োজনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বিশ্বব্যাংক ও কানাডা। প্রতিযোগিতা আয়োজনে সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি বিভাগ ও চ্যানেল আই।
নিয়মিত হালনাগাদ দরকার রাকিব-উল-আলম জ্যেষ্ঠ অ্যান্ড্রয়েড প্রকৌশলী, গোল্ডেন ফ্রগ একেবারে শুরুতে এমন একটি উদ্ভাবনী ধারণা নির্বাচন করতে হবে, যা অন্য কোনো অ্যাপের সঙ্গে মিলে না যায়। এরপর লক্ষ্য নির্ধারণের পাশাপাশি টিকে থাকার জন্য ব্যবসায়ের মডেল কী হবে তা ঠিক করতে হবে। অ্যাপ তৈরি শুরুর আগ থেকেই প্রচার করলে এগিয়ে থাকা সম্ভব। এতে অ্যাপ উন্মুক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি গ্রাহক পাওয়া যায়। উন্নয়নপর্বে অ্যান্ড্রয়েড স্টুডিও এবং জাভা ব্যবহার করতে পারেন। গিট ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রকাশের পর অ্যাপের নিয়মিত হালনাগাদ যেমন দরকার, তেমন গ্রাহকদের পর্যালোচনা গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
গ্রাহকের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিতে হবে হাশমী রাফসানজানি কান্ট্রি মার্কেটিং কনসালট্যান্ট, গুগল বাংলাদেশ অ্যাপ হচ্ছে কোনো সমস্যার সমাধান। সেই সমস্যাটি খুঁজে বের করতে হবে, একজন ব্যবহারকারীর কোন মুহূর্তে কী দরকার তা জানতে হবে। অর্থাৎ গ্রাহকের প্রয়োজনের উপযোগী করেই তৈরি করতে হবে অ্যাপ। অ্যাপ যেন সহজে ব্যবহারযোগ্য হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। যেমন একটি ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে তিন সেকেন্ডের বেশি সময় লাগলে আমরা বিরক্ত হই। গ্রাহক যদি একবার বিরক্ত হয়ে চলে যায় তবে তাঁকে ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।
অ্যাপের উপস্থাপন ভালো হতে হবে স্টিভ অ্যান্থনী জ্যাকব ব্যবস্থাপক (ডিজিটাল বিক্রয়), প্রথম আলো ডিজিটাল একটি ভালো ধারণা থাকলেই সফল হওয়া যাবে তা নয়। অ্যাপের উপস্থাপন ভালো হতে হবে। একটি সফল ব্যবসায়িক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। গবেষণা অনুযায়ী, একজন স্মার্টফোন ব্যবহারকারী দিনে সাধারণত ৫-৬টি অ্যাপ ব্যবহার করেন। এই কটি অ্যাপের মধ্যে আপনার অ্যাপের অবস্থান থাকতে হবে। অ্যাপ থেকে আপনি কীভাবে আয় করবেন, তা নির্ধারণ করতে হবে। বিনা মূল্যের অ্যাপে বিজ্ঞাপন থেকে আয় করতে হয়। প্রিমিয়াম অ্যাপ নামানোর সময় টাকা দিয়ে নামাতে হয়। আরেক ধরনের অ্যাপ আছে যেগুলো ফ্রিমিয়াম (ফ্রি+প্রিমিয়াম) নামে পরিচিত।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.