সারা দেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে গত ৯ মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি হয়েছে ৫৪০ জন। যার মধ্যে ২৩২ জনই শিকার যৌন নিপীড়নের। এছাড়া, এই সময়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে ভর্তি হয়েছে ৩০৩ জন এবং দগ্ধ রোগীর সংখ্যা ৫। আর গত মাসের এ চিত্র রীতিমতো চমকে ওঠার মতো। হাসপাতালটির ওসিসিতে, শুধু অক্টোবর মাসেই ভর্তিকৃত নির্যাতিতার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৭ জনে। তবে সারা দেশে যেসব মেডিকেলে ওসিসি চালু রয়েছে সেখানেও ভর্তিকৃত নির্যাতিতার এ চিত্র ভয়াবহ। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, সম্প্রতি নির্যাতনের পরিমাণ ও মাত্রা দুই-ই বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে কিছু কিছু ঘটনা খুবই বীভৎস। তাদের মতে, ওসিসি থেকে দ্রুত চিকিৎসা ও আইনি সেবা দেয়ার কথা থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আইনি সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতিতাদের ঠিকানাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ওসিসি সূত্রে জানা যায়, এখানে আসা মামলাগুলোর মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশের রায় হয়। আর সাজা পায় মাত্র দশমিক ৪৫ শতাংশ। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সেবায় ২০১১ সালে সরকার দেশব্যাপী ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল চালু করে। ৪০টি জেলা সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই সেল আছে। এসব সেল চিকিৎসা, চিকিৎসা-পরবর্তী ব্যবস্থা, যেমন আইনি পরামর্শ, মামলা, কাউন্সেলিং, আশ্রয় সুবিধা, পুনর্বাসন সহায়তার ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দেয়ার কথা। তবে কাগজে-কলমে সহায়তা দেয়ার কথা থাকলেও চিকিৎসা নেয়ার পর অনেকেই মামলা পরিচালনা করতে চান না। গত বছরের মে মাসে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি জরিপে দেখা যায়, তাদের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা এবং রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল শের-ই-বাংলা, খুলনা, সিলেট এমএজি ওসমানী, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ বছরে ২২ হাজার ৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন। বিচার প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে, এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে পাঁচ হাজার তিনটি। রায় হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের। অর্থাৎ, রায় ঘোষণার হার ৩ দশমিক ৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার দশমিক ৪৫ শতাংশ। রেজিস্ট্রি খাতা অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে সারা দেশের চালুকৃত ওয়ান- স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি হয়েছেন ২৫৩২ জন। কিন্তু মামলা করেছেন মাত্র ৬৩০ জন। গত বছর যৌন নির্যাতনের শিকার হন ৬১৩ জন। এর আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৫৫৫। আর এ বছর আগস্ট পর্যন্ত এ সংখ্যা ৫৭০ ছাড়িয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. বিলকিস বেগম জানান, এ বছর যৌন নির্যাতনের শিকার মারাত্মক আহত বেশকিছু কেস ক্রাইসিস সেন্টারে এসেছে যা আগে কখনো দেখা যায়নি। তিনি এ ব্যাপারে উদ্বেগও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে আমরা মামলা করার জন্য উৎসাহ দিলেও অনেক সময় ভিকটিম নিজেই এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। আমরা তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পাঠিয়ে ফোনও করে দিই। কিন্তু পরে আর ভিকটিমকেই খুঁজে পাই না। এমনও আছে, পরবর্তীতে তাদের ঠিকানাও পাওয়া যায় না। অনেক সময় কিছু মামলার অবস্থা দেখে আমরাই বিস্মিত হয়ে যাই। এক্ষেত্রে তিনি ক্রিকেটার শাহাদাতের বাসার কাজের মেয়ের ওপর চালানো শারীরিক নির্যাতনের উদাহরণ টেনে বলেন, আমি নিজেই প্রমাণ পেয়েছি তার ওপর কি পরিমাণ নির্যাতন চালানো হয়েছে। অথচ মামলার রায়ে বলা হলো, অভিযোগ মিথ্যা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেপুটি ডিরেক্টর ডা. খাজা আবদুল গফুর বলেন, আমরা এখান থেকে সাপোর্ট দিলেও ভিকটিম পরিবার যে এলাকায় বাস করে সে এলাকার দায়ী ব্যক্তিরা থাকেন প্রভাবশালী। ফলে ভয়ভীতি দেখিয়ে তাদেরকে মামলা থেকে বিরত রাখা হয়। আবার অনেকে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার আশঙ্কা থেকে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করতে ভিকটিমকে সামনে হাজির করেন না। কারণ জানাজানি হয়ে গেলে ভবিষ্যতে মেয়েটির বিয়ে-শাদি দিতেও সমস্যা হয়। হাসপাতালের উপ-পরিচালক বিচারহীনতার জন্য অর্থনৈতিক লেনদেনকেও দায়ী করেন। বলেন, ভিকটিম পরিবার সাধারত তাদের মেয়েটির ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ওই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। সেক্ষেত্রে তারা জড়িতদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে নতুন এলাকায় বসবাস করেন। এমন অনেকে আছেন, যারা তাদের ভিটেবাড়ি বিক্রি করে অন্য এলাকায় চলে গেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওসিসিতে যারা চিকিৎসা নিতে আসেন, তাদের বড় অংশই দরিদ্র পরিবারের। ধর্ষণের শিকার শিশুর বয়স ১০ বছরের নিচে হলে পরিবারগুলো টাকা দিয়ে মীমাংসা করে ফেলে। দশ বছরের বেশি হলে ধর্ষকের সঙ্গে বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। ধর্ষণের শিকার হয়ে ওসিসিতে আসা নারী-শিশুকে আইনগত সহযোগিতা দেয় বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। তাদের নিয়োগকৃৃত আইনজীবীরা এসব মামলা পরিচালনা করেন। কিন্তু সমঝোতার ক্ষেত্রে তাদেরও কিছু করার থাকে না।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.