কলম্বিয়ার সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী গোষ্ঠী ফার্কের সঙ্গে নতুন করে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছে দেশটির সরকার। এর আগে উভয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি গণভোটের মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করে কলাম্বিয়ানরা। পরে ওই চুক্তিতে কিছু পরিবর্তন এনে তৈরি করা হয় নতুন চুক্তি। গণভোটে অনুসমর্থনের বদলে এবারে তা অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হয়েছে কংগ্রেস। দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে ফার্ক গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে চলমান বিবাদ-মীমাংসার জন্যই এই চুক্তি করা হয়েছে। ওই সংঘাতে এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ, অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছেন প্রায় ৫০ লাখ। বিবিসি’র খবরে বলা হয়, বিদ্রোহী ফার্কের সঙ্গে বিবাদের অবসান ঘটাতে গত ২৬শে সেপ্টেম্বর কলাম্বিয়ান প্রেসিডেন্ট ম্যানুয়েল সান্তোস ও ফার্ক নেতা রড্রিগো লনডোনো ‘টিমোচেংকো’ স্বাক্ষর করেন শান্তিচুক্তিতে। জাঁকজমকপূর্ণ ওই অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, কিউবান প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ত্রো, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। তবে এর এক সপ্তাহ পরই ২রা অক্টোবর অনুষ্ঠিত এক গণভোটে ওই চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ কলাম্বিয়ান জনগণ। তবে শান্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রেসিডেন্ট সান্তোস। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার নতুন করে তৈরি করা শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন সান্তোস ও টিমোচেংকো। রাজধানী বোগাটায় চুক্তি স্বাক্ষরের পর তা হস্তান্তর করা হয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্টের কাছে। রাজধানীর কোলোন থিয়েটারে এই চুক্তিস্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৮শ’ মানুষ। দুই নেতার মধ্যে চুক্তিস্বাক্ষরের পর সমবেত জনতা উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দেন এবং স্লোগান দেন ‘হ্যাঁ, আমরাও পারি।’ টিমোচেংকো বলেন, এই চুক্তি ‘নিশ্চিতভাবেই যুদ্ধের অবসান ঘটাবে যাতে করে আমরা বিরোধগুলো আরো পরিশীলিত উপায়ে সমাধান করতে পারি।’ প্রেসিডেন্ট সান্তোস বলেন, সংশোধিত চুক্তি আগের চুক্তির তুলনায় ‘উন্নততর’, কারণ এই চুক্তিতে এমন বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে যে বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বেগের কারণেই অক্টোবরের গণভোটে জনগণ এর বিরুদ্ধে ‘না’ ভোট দিয়েছিল। তিনি এ বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন যে চুক্তির বাস্তবায়নে এক মুহূর্তও দেরি করা যাবে না এবং উপস্থিত অথিতিদের কল্পনা করতে বলেন যে ফার্কের সঙ্গে পুনরায় যুদ্ধ শুরু হলে তা কেমন হবে। তিনি বলেন, কংগ্রেস আগামী সপ্তাহেই এই চুক্তিতে ভোট দেবেন বলে আশা করছেন তিনি। নতুন চুক্তি প্রয়োজন হলো কেন? ফার্কের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গত চার বছর ধরেই আলোচনা করে আসছিল কলম্বিয়া সরকার। এ বছরের শুরুতে এই বিরোধ মেটাতে উভয় পক্ষ সমঝোতায় আসতে সম্মত হয়। ২৬শে সেপ্টেম্বর আবেগঘন এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তা সই হয় উভয় পক্ষের মধ্যে। তবে ওই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গণভোটে কলাম্বিয়ানদের অনুসমর্থনের প্রয়োজন ছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের সময় সান্তোস জনগণকে গণভোটে এই চুক্তির পক্ষে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। জনমত জরিপের ফলাফল থেকে ধারণা করা হচ্ছিল বিপুল ব্যবধানেই চুক্তিতে সমর্থন জানাবে কলাম্বিয়ানরা। তবে জনমত জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করে ১ শতাংশেরও কম ভোটে চুক্তিটি গণভোটে প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর কী হয়েছিল? চুক্তি প্রত্যাখ্যাত হলেও দুই পক্ষই এ বছরের শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এ সময়ের মধ্যে পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনার করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। সেপ্টেম্বরের শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন কলম্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট আলভারো ইউরিব। প্রেসিডেন্ট সান্তোস তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ওই চুক্তিতে তার বিরোধের বিষয়গুলো সম্পর্কে আলোচনা করেন। পরে কলম্বিয়া সরকার ও ফার্ক আবার আলোচনার টেবিলে বসে আগের চুক্তিতে কিছু সংশোধনী নিয়ে আসেন। এই সংশোধনীগুলো এমনভাবে করা হয় যেন আগেরবার যারা ‘না’ ভোট দিয়েছিলেন তারা নতুন চুক্তিকে গ্রহণ করতে পারেন। আগের চুক্তির ৫৭টি ধারার প্রায় সবগুলোতেই কিছু কিছু পরিবর্তন আনা হয়। কী পরিবর্তন করা হয়েছে নতুন চুক্তিতে? আগের চুক্তির প্রায় সব বিষয়ে পরিবর্তন আনা হলেও এর মধ্যে পাঁচটি পরিবর্তন মুখ্য। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ফার্কদের তাদের সব সম্পদ ছেড়ে দিতে হবে এবং সেগুলো হস্তান্তর করতে হবে। যে অর্থ পাওয়া যাবে তা সংঘাতের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আগের চুক্তিতে বিভিন্ন ধর্মীয় দলের উদ্বেগ ছিল যে এতে পারিবারিক মূল্যবোধকে অসম্মান করা হয়েছে। এ বিষয়টিতে নজর দেয়া হয়েছে নতুন চুক্তিতে। অন্তর্বর্তীকালীন বিচার ব্যবস্থায় ১০ বছরের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। ফার্করা সংঘাতের সময়ে যদি কোনো ধরনের মাদক পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে থাকে তবে তার যাবতীয় তথ্য তাদের প্রকাশ করে দিতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই শান্তিচুক্তিকে কলম্বিয়ার সংবিধানের কোনো অংশে পরিণত করা হবে না। এখন কী হবে? নতুন শান্তিচুক্তিটির ওপর কংগ্রেস ভোট প্রয়োগ করবে। কংগ্রেসে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় আগামী সপ্তাহেই সম্ভবত তা কংগ্রেসে অনুমোদিত হবে বলে জানিয়েছেন কলম্বিয়ার একজন মন্ত্রী। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউরিবের ডেমোক্রেটিক সেন্টার পার্টি এরই মধ্যে জানিয়েছে যে, তারা কংগ্রেসে এই চুক্তির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। দলটির নেতারা বলছেন, নতুন চুক্তিতে আনা পরিবর্তনগুলো ‘বাহ্যত’। এ ছাড়া সরকার নতুন এই চুক্তিকেই ‘চূড়ান্ত’ বলে দিয়েছে- তা নিয়েও আপত্তি রয়েছে তাদের। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ফার্ক বিদ্রোহীদের মধ্যে যারা অপরাধ করেছে তাদের আরো কঠোর শাস্তি দিতে হবে। চুক্তির বিভিন্ন ধারায় তাদের আরো কিছু প্রস্তাবনা মেনে নেয়ার দাবিও রয়েছে তাদের। দলটির দাবি, নতুন চুক্তিকেও পুনরায় গণভোটে পাঠানো হোক। তবে নতুন করে একটি গণভোটের প্রস্তাব প্রেসিডেন্ট সান্তোস ও ফার্ক উভয়েই উড়িয়ে দিয়েছেন। কংগ্রেসের অন্য দলগুলো অবশ্য চুক্তির পক্ষেই মত দিয়েছে। ফলে এই চুক্তিটি এবারে অনুমোদিত হয়ে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.