কফি আনানের সফরের মধ্যেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন অব্যাহত রয়েছে। গত শুক্রবারও নতুন নতুন গ্রামে সেনা ও পুলিশ অভিযান চালিয়ে নির্যাতন করেেছ। সীমান্তবর্তী শহর মংডুর আশপাশে অন্তত দুটি গ্রামে শুক্রবার সন্ধ্যার পরও হামলা হয়েছে। কাউয়ারবিল ও পেরাংপ্রু নামে দুটি গ্রাম থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা কয়েকজন আশ্রয়প্রার্থী নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। পালিয়ে আসা লোকজনের দাবি, সেনা ও পুলিশ এসব গ্রামে ঢুকে গুলি চালিয়েছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতে অন্তত ৬ জন রোহিঙ্গা নিহত এবং ২৫ জনের মতো নিখোঁজ রয়েছে। আগুনে পুড়ে গেছে ৩০টির বেশি ঘরবাড়ি। দুই গ্রামের অন্তত দেড় হাজার রোহিঙ্গা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। তারা সেখানকার ধানখেত, নাফ নদীর তীরের প্যারাবন ও গাছের নিচে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। গতকাল শনিবার ভোররাতে টেকনাফে পালিয়ে আসেন ওই দুটি গ্রামের ২১ জন রোহিঙ্গা। তাঁদের মধ্যে তিনজন পুরুষ ও দুই নারীর সঙ্গে প্রথম আলোর সাংবাদিকদের কথা হয়েছে। এই দলের একজন বেগম বাহার (৩২) বলেন, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পেরাংপ্রু গ্রামের গৃহহীন শতাধিক রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে পাশের উপকূলীয় প্যারাবনে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানেও গুলি চালায় পুলিশ। এতে তাঁর স্বামী আবদুর রশিদসহ অন্তত ছয়জন রোহিঙ্গা নিহত হন। গত দুই মাসে মংডু শহরের আশপাশের আমতল্ল্যা, জামবইন্ন্যা, গজিরবিল, নাইছাপ্রু, কাউয়ারবিল, পুয়াংখালী, গোয়ানখালী, সিকদারপাড়া, বলিবাজার, রইগ্যাদং, পেরাংপ্রু, ফাতংজা, কাদিরবিল, মংনিপাড়া, গোজারবিলসহ অন্তত ২০টি গ্রামের ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি আগুনে ধ্বংস করা হয়েছে। এসব গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সেনা ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে শতাধিক নারী, পুরুষ, শিশু। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নারী। কফি আনানের সফর বার্তা সংস্থা এএফপি ও রয়টার্স জানায়, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানসহ নয় সদস্যের বিশেষ কমিশন গত শুক্রবার রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তে শহরে পৌঁছায়। গত সেপ্টেম্বরে এই কশিমন গঠনের পর এটি রাখাইন রাজ্যে কফি আনানের দ্বিতীয় সফর। বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই সিত্তে শহরের স্থানীয় রাখাইন লোকজন কফি আনানের উদ্দেশে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তারা স্লোগান দিয়ে এই কমিশনকে ফিরে যেতে বলে। তারা বলে, সাম্প্রতিক ঘটনা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এতে বাইরের কাউকে নাক গলাতে দেওয়া হবে না। এএফপি জানায়, গতকাল শনিবার কফি আনান এবং তাঁর কমিশনের সদস্যদের বহনকারী গাড়িবহর মংডুর কাছাকাছি ওয়াপেইক গ্রামে যায়। কমিশনের সদস্যরা ওই গ্রাম ঘুরে দেখেন। সাম্প্রতিক সেনা অভিযানে এই গ্রামে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এই গ্রামের ঘরবাড়িতে সেনাসদস্যদের অগ্নিসংযোগের ছবিও ছাপা হয়েছে। বিশেষ কমিশনের এই সফরের সময় রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমের সাংবাদিক ছাড়া অন্য কোনো সাংবাদিক ছিলেন না। তাঁদের ওই গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে এএফপির আলোকচিত্রী জানিয়েছেন। রাখাইন রাজ্য সফর শেষে কফি আনান আগামী মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমকে ব্রিফ করতে পারেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ঢুকে পড়ছে রোহিঙ্গারা গত দুই মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা অন্তত ১৬ হাজার রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থান করছে। রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালনকারী স্থানীয় বিভিন্ন কমিটির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই হিসাব পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে বহু রোহিঙ্গা সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও পাহাড়ে বাঁশ, কাঠ, পলিথিন দিয়ে মাটির ঘরবাড়ি তৈরি করছে। রোহিঙ্গা নেতাদের বিভিন্ন সূত্র জানায়, উখিয়ার কুতুপালং পাহাড়ে কয়েক বছর ধরে বসতি গড়েছে ৭০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। সম্প্রতি রাখাইন রাজ্য থেকে এখানে নতুন করে ঢুকেছে প্রায় ৯ হাজার রোহিঙ্গা। টেকনাফের লেদা এলাকায় কয়েক বছর ধরে বসবাস করছে ৩৫ হাজার রোহিঙ্গা। সম্প্রতি সেখানে যোগ দিয়েছে আরও প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা। কিন্তু বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা থাকার জায়গা না পেয়ে বনজঙ্গলে হামলে পড়েছে। গতকাল শনিবার সকালে কুতুপালং শিবিরে গিয়ে দেখা গেছে, দক্ষিণের বনাঞ্চলে মাটির দেয়াল ও পলিথিনের ছাউনিযুক্ত একটি ঘর তৈরি করেছে রোহিঙ্গারা। সেখানে থাকছে তিনটি রোহিঙ্গা পরিবারের প্রায় ১৯ জন। এর আশপাশে বনভূমি দখল করে তৈরি হচ্ছে আরও ঘরবাড়ি। টেকনাফের লেদা শিবিরের আশপাশের বনাঞ্চল দখল করেও ঘরবাড়ি তৈরির হিড়িক পড়েছে। কক্সবাজার (দক্ষিণ) বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) আলী কবির বলেন, কয়েক বছর ধরে টেকনাফ ও উখিয়ার প্রায় ৩০০ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে থাকছে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা। নতুন করে এসেছে আরও ১৫-২০ হাজার। তারাও প্রায় ২০০ একরের মতো সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ঢুকে পড়েছে। সেখানে তারা ঘরবাড়ি তৈরির চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে টেকনাফের লেদা ও উখিয়ার কুতুপালং এলাকায় বেশ কিছু ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। বিজিবির প্রস্তাব দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধ ও রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এক বছর আগে কিছু সুপারিশ তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠিয়েছিল। এখন তার বাস্তবায়ন জরুরি মনে করছেন স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোকেরা। সুপারিশমালায় উখিয়া ও টেকনাফের চারটি পৃথক রোহিঙ্গা শিবিরে কাঁটাতারের বেড়া অথবা নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করার কথা বলা হয়েছিল। এসব শিবিরে একটিমাত্র প্রবেশ ও বহির্গমন পথ থাকবে। থাকবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত চেকপোস্ট। অনিয়ন্ত্রিত চলাচল রোধে রোহিঙ্গাদের যথাযোগ্য ছাড়পত্র দেওয়া এবং চেকপোস্টগুলোতে বিজিবিকে সম্পৃক্ত করার সুপারিশ ছিল। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, শিবিরগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে রোহিঙ্গাদের এদিক-সেদিক যাওয়া বন্ধ হতো। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, গত দু-তিন সপ্তাহে উখিয়া-টেকনাফে ঢুকেছে ১৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। সংরক্ষিত একটি জায়গায় রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। সমাজের সঙ্গে মিশে যাওয়ার আগে রোহিঙ্গাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা জরুরি। অনুপ্রবেশ চলছেই টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি দুদু মিয়া বলেন, গতকাল শনিবার এই শিবিরে নতুন করে ঢুকেছে প্রায় ৭০০ রোহিঙ্গা। উখিয়ার কুতুপালং শিবিরে ঢুকেছে প্রায় ১ হাজার ৩০০ জন। এর আগে এই দুই শিবিরে ঢুকেছে আরও ১৫ হাজার ২০০ রোহিঙ্গা। নাফ নদীর তীরের গ্রাম নয়াপাড়া, মুছনী, জাদিমুরা ও লেদা এলাকার বিভিন্ন ঘরে অবস্থান করছে আরও তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা। বিজিবি ও কোস্টগার্ডের টহলের কারণে তারা শিবিরে ঢুকতে পারছে না। টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল সিদ্দিকী বলেন, নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফে অনুপ্রবেশের সময় শনিবার ভোররাতে চারটি নৌকাবোঝাই ৮০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.