প্রায় ১৮ বছরের শিক্ষাজীবন শেষে বেকার ছেলেমেয়েরা পরিবারের কাছেও অনেকটা বোঝা হয়ে ওঠেন। আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজন সবারই প্রথম প্রশ্ন, চাকরিবাকরি এখনো হলো না? দুঃসহ এই সময়টাতে এসে আবার বেকারের ব্যয় বেড়ে যায় অনেকটাই।
ছাত্রজীবনে থাকা-খাওয়ার খরচের সঙ্গে তখন যোগ হয় চাকরির আবেদনের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চাওয়া পে-অর্ডার, ট্রেজারি চালান কিংবা অন্য কোনো উপায়ে নেওয়া টাকার চাহিদা। টিউশনি করে, পরিবারের কাছ থেকে এনেও এত টাকার সংস্থান না হওয়ায় অনেক চাকরির দরখাস্তই করেন না কেউ কেউ।
ওদিকে চাকরির বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বেকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মুনাফা করছে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রার্থী নিয়োগের উদ্দেশ্যে নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণের সাংবিধানিক দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনও (বিপিএসসি) এ ক্ষেত্রে কম নয়। শুধু বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া প্রার্থীদের কাছ থেকেই সংস্থাটি আদায় করে নিচ্ছে খরচের তিন গুণের বেশি টাকা, যা চূড়ান্ত হিসাবে সংস্থাটির মুনাফা হিসেবে যোগ হচ্ছে সরকারের কোষাগারে।
বিপুল এই মুনাফার ফলে পরীক্ষার আবেদনপত্র বাছাই, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, পূর্ণ উত্তরপত্র পরীক্ষণ, ক্রুটিনাইজার, মৌখিক পরীক্ষায় বিশেষজ্ঞদের সম্মানী, পরীক্ষা হলের পরিদর্শক, অফিস সহায়ক, পরীক্ষার সময় নিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও গার্ডদের সম্মানী বাড়িয়ে দ্বিগুণ করতে গত ২৩ নভেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বিপিএসসি। তাঁদের সম্মানীর পুরো অর্থই চাকরির আবেদনকারীদের কাছ থেকে নেওয়া ফিসের অর্থ থেকে বহন করা হয়ে থাকে।
৩৪তম বিসিএস পর্যন্ত আবেদনকারীদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে ফি নিত বিপিএসসি। তাতেও পরীক্ষার সব খরচ শেষে মুনাফা হতো সংস্থাটির। তা সত্ত্বেও ৩৫তম বিসিএসের বিজ্ঞাপনে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যকর করেছে সংস্থাটি। ফলে পরীক্ষা নেওয়ার সব কার্যক্রমের খরচ ওই ফিস থেকে বহন করার পরও ৩৪তম বিসিএসের তুলনায় ৩৫তম বিসিএসে মুনাফা তিন গুণ বেড়েছে। আর ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেই ৯০ শতাংশ প্রার্থী বাতিল করায় লিখিত পরীক্ষার পেছনে বিপিএসসির খরচ কমে গেছে। ফলে ৩৩তম ও ৩৪তম বিসিএসের তুলনায় ৩৫তম বিসিএস সম্পন্ন করতে প্রতিষ্ঠানটির খরচ কম হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো বিপিএসসির সচিব মো. নূরুন নবী তালুকদার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ৩৫তম বিসিএসে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ফিস বাবদ বিপিএসসির আয় হয় ১৫ কোটি ৯ লাখ দুই হাজার ৭৩০ টাকা। আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ৩৫তম বিসিএসের
পেছনে বিপিএসসির ব্যয় হয়েছে চার কোটি ৫০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৩৫তম বিসিএসে আবেদনকারীদের কাছ থেকে খরচের চেয়েও অতিরিক্ত ১০ কোটি ৫৯ লাখ দুই হাজার ৭৩০ টাকা বেশি নিয়েছে সংস্থাটি।
বিপিএসসির কর্মকর্তারা জানান, ৩৫তম বিসিএসে দুই লাখ ৪৪ হাজার ১০৭ জন প্রার্থী আবেদন করেন। ২০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শেষে ২০ হাজার ৩৯১ জনকে টেকানো হয়। অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন আবেদনকারীর মধ্যে ৯২ জন ৭০০ টাকা করে ফি দিয়ে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শেষেই বাতিল হয়ে যান। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ছয় হাজার ৮৮ জন, যেখান থেকে দুই হাজার ১৫৮ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে বিপিএসসি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩৪তম ও ৩৩তম বিসিএসেও ব্যয়ের চেয়ে ফিস থেকে আয় অনেক বেশি ছিল। ৩৪তম বিসিএসে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ৯ কোটি ৮৭ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৫ টাকা ফিস নেয় সংস্থাটি। আর এই বিসিএস সম্পন্ন করতে মোট ব্যয় হয় ছয় কোটি ৩৬ লাখ ছয় হাজার ৭২১ টাকা। অর্থাৎ আবেদনকারীদের কাছ থেকে বিপিএসসি অতিরিক্ত নেয় তিন কোটি ৫১ লাখ ৮১ হাজার ৪৬৪ টাকা। একইভাবে ৩৩তম বিসিএসে আবেদনকারীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত নেওয়া হয় তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮৭ টাকা। ওই বিসিএসে আবেদনকারীদের কাছ থেকে ফিস হিসেবে বিপিএসসি নেয় আট কোটি ১৯ লাখ ৫৬ হাজার ২০৫ টাকা, খরচ হয় পাঁচ কোটি চার লাখ ৯ হাজার ৩১৮ টাকা।
প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রেই যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তার চেয়ে বেশি অর্থ আবেদনকারীদের কাছ থেকে ফিস হিসেবে পাওয়া যায় জানিয়ে বিপিএসসির সচিব মো. নূরুন নবী তালুকদার বলেছেন, ‘একটি বিসিএস পরীক্ষার ব্যয় কোনোভাবেই আয়ের বেশি হচ্ছে না। ’
ব্যয়ের তুলনায় বিসিএসের ফিস থেকে আয় বেশি হওয়ার তথ্য তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে পরীক্ষা নেওয়ার সঙ্গে ১৩ ক্যাটাগরিতে সংশ্লিষ্টদের সম্মানী বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নপত্র রচনার ক্ষেত্রে পূর্ণ পত্রের জন্য সম্মানী তিন হাজার থেকে বাড়িয়ে পাঁচ হাজার টাকা, আংশিক পত্রের জন্য দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর পেছনে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন-মডারেশনের কাজে সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিব, সমমর্যাদাসম্পন্ন কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য-উপ-উপাচার্য, অধ্যাপক, রাষ্ট্রদূত, বিশিষ্ট সাংবাদিক, সুশীল সমাজের প্রথিতযশা খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞগণকে কমিশন ভবনে এসে নির্ধারিত কক্ষে বসে কাজ করতে হয়। তাঁদের সকাল ১০টা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকেল ৫টা পর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাধিক দিন বিরতিহীনভাবে এ কাজ করতে হয়। নিজস্ব যানবাহনে জ্বালানি ব্যবহার করে স্বনামধন্য, প্রথিতযশা ও খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞগণ কমিশনে এসে এ কাজ করেন। কমিশনে আগত বিশেষজ্ঞগণ এ কাজের জন্য কোনো টিএ/ডিএ পান না। ’
মো. নূরুন নবী তালুকদার বলেছেন, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের স্পর্শকাতর কাজ সম্পাদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের ধার্য করা পারিতোষিক বর্তমান বাজার মূল্যে অপ্রতুল হওয়ায় এবং এই অপ্রতুল অর্থ প্রাপ্তিতেও দীর্ঘসূত্রতা থাকায় উচ্চপদস্থ, অভিজ্ঞ ও খ্যাতিমান বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের কাজ করতে অবিরত অনীহা প্রকাশ করে আসছেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত পারিতোষিক বর্তমান বাজার মূল্যে অত্যন্ত অপ্রতুল হওয়ায় বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব পালনে অনীহার কারণে সিভিল সার্ভিসে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া এবং নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের গুণগতমান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে ধরে রাখা বা উন্নীত করা কমিশনের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাই উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিভিল সার্ভিস নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও উত্তরপত্র মূল্যায়নের গুণগত মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য পারিতোষিকের হার যৌক্তিক হারে বাড়ানো আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
পারিতোষিক বাড়ানোর প্রস্তাবের পক্ষে তিনটি যুক্তি তুলে ধরেছে বিপিএসসি। যুক্তিগুলো হলো—‘বিসিএস পরীক্ষা গ্রহণে গুণগতমান নিশ্চিত করা, অর্থাৎ যোগ্য প্রশ্নকারক, পরীক্ষক ও নিরীক্ষককে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পারিতোষিক প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহিত করা। মৌখিক পরীক্ষায় একজন বিশেষজ্ঞ ও বিভাগীয় বিশেষজ্ঞকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা সময় দিতে হয়। উল্লিখিত বিশেষজ্ঞদের যাতায়াত এবং সৃজনশীল মননচর্চার বিষয়টি এত সামান্য পারিতোষিকের মাধ্যমে পাওয়া দুষ্কর। ’ মৌখিক পরীক্ষা বোর্ডে সভাপতি ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারীরা বর্তমানে তিন হাজার টাকা করে সম্মানী পান। এটি বাড়িয়ে ছয় হাজার করার প্রস্তাব দিয়েছে বিপিএসসি।
তৃতীয় যুক্তিতে বিপিএসসি বলেছে, ‘পারিতোষিকের নির্ধারিত হার কম হওয়ায় উত্তরপত্র পরীক্ষণে বিশেষজ্ঞদের নিরুৎসাহিত হওয়ার কারণে বিসিএস পরীক্ষাসহ সব নিয়োগের ফলাফল দিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.