মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমরা পাড়ি জমাচ্ছে প্রতিবেশী দেশগুলোতে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রথম গন্তব্য বাংলাদেশ হলেও কড়া সীমান্ত পাহারার কারণে তারা বাধ্য হচ্ছে অন্যখানে যেতে। বর্তমানে অনেক রোহিঙ্গার নতুন আশ্রয়স্থল আরেক উত্তপ্তভূমি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মির। সংবাদসূত্র : হিন্দুস্তান টাইমস, আটলান্টা জার্নাল ভারতের পত্রিকা ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ রোববার জানায়, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে নিজ ভূমি রাখাইন ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গারা। বছরের পর বছর ধরে তারা আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায়। সম্প্রতি নির্যাতন বেড়ে গেলে একই চেষ্টা শুরু করে তারা।
ভারতের জম্মু ও কাশ্মিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে তৈরি করা এক প্রতিবেদনে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর অত্যাচারের বর্ণনা দেন ৭০ বছর বয়সী মোহাম্মদ ইউনুস এবং তার চেয়ে বয়সে ছোট শাহ আলম। বর্বর নির্যাতনের বর্ণনায় বার বারই বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন তারা। হতাশা চেপেছেন দীর্ঘশ্বাসে। তবু তাদের একটাই সান্ত্বনা_ এখনো বেঁচে আছেন। ইউনুস বলেন, ‘চার বছর আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে জম্মুতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলাম। বিশ্বের মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের ওপর এত অত্যাচারেও নিশ্চুপ ছিল। আমাদের সামনেই সেনাসদস্যরা মেয়েদের ধর্ষণ করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়িঘর, পুড়িয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে অনেক রোহিঙ্গাকে।’ অত্যাচারের স্মৃতি বয়ে বেড়ানো ইউনুস কথার এক ফাঁকে নিজ শরীরের কাপড় সরিয়ে সেনাদের ছোড়া বুলেটের দাগও দেখান। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন জম্মুতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বিশেষ কার্ড দিয়েছে। আবার তাদের অনেকেই কোনো কাগজপত্র ছাড়াই সেখানে অবস্থান করছে। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা ৪৫ বছর বয়সী শাহ আলম বলেন, ‘জম্মুতে আমি ঝুট ব্যবসা করি। আমার স্ত্রী আর মেয়ে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। আমাদের আয় খুব কম। এর মধ্যে কুঁড়েঘরের ভাড়া বাবদ ৫০০ এবং বিদ্যুতের জন্য ২০০ রুপি দেয়ার পর হাতে তেমন কিছু থাকে না। কিছু বেসরকারি সাহায্য সংস্থা আমাদের সহায়তা করে। তবু জীবন ধারণ অনেক কষ্টের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এরপরও আমরা খুশি, এখানে অন্তত নিরাপদে আছি।’ জম্মুতে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের দাবি, সম্প্রতি শুরু হওয়া নির্যাতনের মুখে অন্তত ৩০-৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। অন্যরা ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও সৌদি আরবে পালিয়ে যাচ্ছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারে তাদের সঙ্গে কোনো মানবিক আচরণ করা হয় না। তাদের মতো মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকারও যেন নেই। তাদের বিয়ের জন্য অনুমতি নিতে হয়, বিবাহিত নারীদের সন্তান ধারণের জন্যও অনুমতি নিতে হয়। অন্যদিকে, বেঁচে থাকার জন্য তারা কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন না। রাতে চলাচলেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি বলেছিলেন, এখন পর্যন্ত কাশ্মিরের আশ্রয়শিবিরে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তবে এসব শরণার্থীকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছে ভারতের বিভিন্ন সংস্থা। সম্প্রতি বিদেশি জঙ্গিদের তৎপরতার বিষয়টিও নজরে এসেছে। এজন্য রোহিঙ্গাদের ওপর বিশেষ নজরদারিও রয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে জর্জিয়ায় বিক্ষোভ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মুসলিম রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে আমেরিকায় বিক্ষোভ হয়েছে। দেশটির জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আটলান্টার ‘সিএনএন’ সেন্টারের সামনে রোববার ওই বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীরা মিয়ানমারে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের কাছে অনুরোধ জানান। আমেরিকার নিবন্ধন অনুযায়ী, ২০১২ সালে মিয়ানমার থেকে ৩ হাজার ৭৪৪ জন জর্জিয়ায় শরণার্থী হয়েছে। বিক্ষোভ মিছিলের সংগঠক মুহাম্মদ হোসাইন জানান, আটলান্টায় কয়েকশ’ রোহিঙ্গা বাস করছে। তারা সিএনএন সেন্টারের সামনে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে নানা রকম ফেস্টুন নিয়ে বিক্ষোভ করেন। তিনি মিয়ানমারে গণহত্যা ও নির্বিচারে গণগ্রেপ্তার বন্ধে আন্তর্জাতিক মহল এবং জাতিংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করেন। রাখাইনে ১০ বিদেশি কূটনীতিক এদিকে, মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের মংডু শহর পরিদর্শনে গেছেন ১০ বিদেশি কূটনীতিক। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আমেরিকা, ব্রিটেন, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও চীনের রাষ্ট্রদূতও আছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে রোববার ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখপাত্র ফ্রেদেরিকা মেঘোরিনি বলেন, ‘রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে সেনাশক্তির অপব্যবহার করছে মিয়ানমার সরকার। সেখানকার হাজার হাজার মানুষ নিপীড়নের শিকার।’ অবিলম্বে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। জাতিসংঘের স্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গত দুই মাসে স্বাস্থ্যসেবায় তীব্র সংকটে ভুগছে রাখাইনের মংডু এলাকা। ওই এলাকায় এক সামরিক অভিযানে অন্তত ৮৬ জন নিহত হন। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারের নোবেলজয়ী নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকার বিশ্বব্যাপী কঠোর সমালোচনা, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখোমুখি হচ্ছে
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.