দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার শেষকৃত্য সম্পন্ন হলো পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়, গত মঙ্গলবার বিকেলে। চেন্নাই শহরে ভারত মহাসাগরের কিনারায় মেরিনা বিচে সেইখানে তাঁকে সমাহিত করা হলো, ১৯ বছর আগে যেখানে তাঁরই রাজনৈতিক গুরু ও ‘মেন্টর’ সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এম জে রামচন্দ্রনকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। কর্ণাটকের আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও দ্রাবিড় আন্দোলনের পথিকৃৎ আন্নাদুরাই ও এমজিআরের মতো জয়ললিতার শেষকৃত্যও হলো তাঁদেরই মতো করে। এটাই ছিল তুমুল জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী ও রাজনৈতিক নেত্রীর শেষ ইচ্ছা। জয়ললিতার মরদেহ অ্যাপোলো হাসপাতাল থেকে সোমবার রাতেই চেন্নাইয়ের পোজ গার্ডেনের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। গতকাল সকালে তা নিয়ে যাওয়া হয় ‘রাজাজি হলে’ শেষ দর্শনের জন্য। জয়ললিতার প্রিয় রং সবুজ। সবুজরঙা শাড়িতেই ঢাকা হয় তাঁর শরীর। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেওয়া হয় তাঁর মরদেহ। সকাল থেকেই হাজারে হাজারে মানুষ সেখানে জড়ো হন। রাতেই দিল্লি থেকে চলে এসেছিলেন সংসদীয় মন্ত্রী ভেঙ্কাইয়া নাইডু। সকাল থেকে একে একে আসতে থাকেন ভারতীয় রাজনীতির প্রথম সারির নেতারা। আসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া, মহারাষ্ট্রের দেবেন্দ্র ফড়নবীশ, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল, উত্তর প্রদেশের অখিলেশ যাদবসহ বহু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এসে শ্রদ্ধা জানিয়ে যান। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি রওনা হওয়ার কিছু সময়ের মধ্যেই দিল্লি ফিরে আসেন বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটির দরুন। পরে অন্য বিমানে চেন্নাই পৌঁছে তিনি মরদেহে মালা দেন। প্রায় একই সময়ে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানান কংগ্রেসের সহসভাপতি রাহুল গান্ধী। শোকবার্তা পাঠান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতারা। রাজ্য রাজনীতিতে জয়ললিতার ‘চিরশত্রু’ ডিএমকের শীর্ষ নেতা করুণানিধিও অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে। সেখান থেকে পাঠানো এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, ‘জয়ললিতা ছিলেন অসম্ভব শক্তিশালী ও দৃঢ়চেতা নেত্রী। তাঁর মৃত্যুতে রাজ্য রাজনীতিতে সৃষ্টি হলো এক গভীর শূন্যতা।’ করুণানিধির পুত্র স্ট্যালিনসহ অন্য রাজনৈতিক দলের নেতারাও রাজাজি হলে গিয়ে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন। বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ রাজাজি হল থেকে শুরু হয় শেষযাত্রা। চারদিক কাচ দিয়ে ঘেরা চন্দন কাঠের এক স্বচ্ছ কফিনে রাখা হয় জয়ললিতার মরদেহ। দুই কিলোমিটার দূরে মেরিনা বিচের দিকে ধীরগতিতে এগিয়ে চলে মরদেহবাহী সেনা শকট। জনসমুদ্রের মাঝ দিয়ে ওই পথ পেরোতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মেরিনা বিচে যেখানে শায়িত তাঁর রাজনৈতিক গুরু, অভিভাবক ও ‘মেন্টর’ এম জে রামচন্দ্রন, তার ঠিক পাশেই সম্পন্ন হয় শেষকৃত্য। ওখানেই তৈরি হবে তাঁর স্মৃতিসৌধ। ১৯ বছর আগে ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে এম জি রামচন্দ্রনের মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহও দুদিন ধরে রাজাজি হলে শায়িত ছিল। প্রথম দিন টানা ১৩ ঘণ্টা, দ্বিতীয় দিন ৮ ঘণ্টা সেই মরদেহের এক পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন জয়ললিতা। এবার তাঁর মৃত্যুর পর সেই ভূমিকায় দেখা গেল তাঁর প্রিয়-সখী শশীকলাকে। পরনে কালো শাড়ি। হিন্দুমতে পূজারির সঙ্গে রীতি মেনে শেষকৃত্যও সম্পন্ন করেন শশীকলাই। এমজিআরের সমাধির ঠিক পাশেই সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে মাটির গভীরে নামিয়ে দিল ‘আম্মা’র কফিনবন্দী মরদেহ। সোমবার গভীর রাতেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী পনিরসেলভাম। দুর্নীতির অভিযোগে জেলে থাকার সময় এই পনিরসেলভামই দুবার মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এবার কিন্তু শশীকলাকে নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠে গেছে। উচ্চাভিলাষী শশীকলা শেষ পর্যন্ত এআইএডিএমকের প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠবেন কি না, শুরু হয়েছে সেই জল্পনা। আশঙ্কা ছিল ‘আম্মা’র সমর্থকেরা হিংসাত্মক ঘটনা ঘটাতে পারেন। কেউ কেউ আত্মাহুতি দিতে পারেন। সে জন্য সাবধানতার শেষ ছিল না। কিন্তু দেখা গেল চেন্নাইসহ কোথাও অঘটন কিছু ঘটেনি। যদিও সারাটা দিন তামিলনাড়ুতে পালিত হয় অঘোষিত বন্ধ। বন্ধ ছিল সব অফিস, স্কুলসহ সবকিছুই।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.