‘শীত এসেছে লাগলো কাঁপন, লাগলো দোলা প্রাণে/শীত এসেছে হিমেল হাওয়া, আনন্দ আর গানে…।’ আজ পয়লা পৌষ। ১৪২৩ বঙ্গাব্দ। চারদিকে কুয়াশার বিস্তার। বেলা না গড়ালে স্পষ্ট হয় না চারপাশ। গাছের পাতার গায়ে হলদে রঙ। শোনা যাচ্ছে পাতাঝরার শব্দ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় হু-হু কাঁপন, বাতাসে শীতের আমেজ। গরম চা আর ধোঁয়া ওঠা ভাঁপাপিঠা পথে পথে। বদলে যাচ্ছে পোশাক-আশাক, বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। প্রবচন সাক্ষ্য দেয় ‘তেরোই ভাদ্র শীতের জন্ম’। কিন্তু বাংলা ঋতুক্রমে পৌষেই শুরু হয় শীতকাল। বাংলা বর্ষপঞ্জিকা অনুসারে, এ হিমেল ঋতুর দৈর্ঘ্য পৌষ ও মাঘ (মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি) এই দুই মাস। এ সময় সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান করে বলে বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে সূর্যের রশ্মি পড়ে তীর্যকভাবে। সূর্য মকরক্রান্তি বরাবর অবস্থান নেয়ায় দিন ক্রমেই ছোট হয়ে আসে। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। সেখান থেকে বরফশীতল বায়ু বাংলাদেশের ওপর কমাতে থাকে তাপমাত্রা, অনুভূত হয় শীত। বাড়ে রাতের দৈর্ঘ্য, কমে দিনের। দিন দিন বাড়ে শীতের প্রকোপ। প্রকৃতির নিয়মে উত্তুরে হাওয়ায় ভর করে প্রতিবারের মতো এবারো এসেছে পৌষ। স্বাগত, কুয়াশাময় পৌষ। তবে দুই সপ্তাহ ধরেই কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় শীত তার নিজের আগাম আগমনবার্তা জানান দিচ্ছে সারা দেশে। অনেকটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার পঙ্ক্তির মতো- ‘আমলকীর শাখায় কাঁপন ধরিয়ে আর অশ্রুপাথার হিম-পারাপার পারায়ে।’ সন্ধ্যা নামতেই বইতে শুরু করে কুয়াশাভেজা হিম বাতাস। আট থেকে নয় মাস বস্তাবন্দি হয়ে থাকা লেপ-কম্বলও স্থান পেয়েছে বিছানায়। রাতভর শিশির পতনের শব্দ গুঞ্জরণ তুললেও সকাল হলেই দেখা মেলে না সূর্যের। এসবকে সঙ্গী করেই ঋতু পরিক্রমায় আজ শুরু হচ্ছে শীতকাল। ইতিমধ্যেই প্রকৃতি ধারণ করেছে জীবনানন্দ দাশের পঙ্্ক্তির সে রূপ- ‘শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;/নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি/উড়ে গেলো কুয়াশায়।’ বাংলা সাহিত্যে শীত ঋতু ব্যাপকভাবে চিত্রিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। তার ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতায় লিখেছেন- ‘আমরা হেঁটেছি যাঁরা নির্জন খড়ের মাঠে পৌষ সন্ধ্যায়/দেখেছি নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল কুয়াশার…’। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই চারটি ঋতু। শীত ঋতু আছে বিশ্বজুড়েই। পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের শীতের সঙ্গে বাংলাদেশের শীতের পার্থক্য বিস্তর। কোনো কোনো দেশে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে। খুব কাছের দেশ চীনেও তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নয়-দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়! মেরু অঞ্চল বা এন্টার্কটিকার কথা তো বলাই বাহুল্য। অথচ বাংলাদেশে তাপমাত্রা ছয় থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে খুব একটা নামে না। সেদিক থেকে বাংলাদেশের শীত অনেকখানি উপভোগ্য। ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’- শুভাশুভ দুই বার্তায় নিয়ে ঋতুচক্রে বাংলার প্রকৃতিতে ফিরে আসে পৌষ মাস। অগ্রহায়ণ গ্রামবাংলায় যে নবান্ন উৎসব এনে দেয় তা অব্যাহত রাখে পার্বনের মাস রসালো পৌষ। পৌষ পার্বণ মানে নতুন চালে পিঠা-পুলির উৎসব। কৃষকের গোলায় নতুন ধান। খেঁজুরের গাছে গাছে রসের টিলা। পৌষের শীতে বাড়িতে বাড়িতে চলে পিঠাপুলির আয়োজন। পিঠার গন্ধে ম ম করে সারা গ্রাম। বাংলার পিঠাপুলির যেমন রয়েছে নাম-প্রকারের বৈচিত্র্য, তেমন বৈচিত্র্যময় এর স্বাদ। পৌষ এলেই নববধূরা বয়সীদের কাছে শিখে নেয় চাউনি-বাউনির রীতি ও গল্প। মুখে মুখে ফিরে খেজুর রস, মালপোয়া, পুলিপিঠা, আন্দেশা, এলোকেশী, জামাইমুখ, পদ্মদিঘি, চন্দ্রপুলি, কন্যামুক, ময়ূর পেখম, পাটিসাপটা, মুগপাকন, ভাঁপাপিঠা আর ছিটপিঠার নাম। প্রতিটা সকালে স্নিগ্ধ রোদে বসে পিঠাপুলি খেয়ে দিন শুরু করে গ্রামবাংলার মানুষ। পৌষ মানেই গ্রামবাংলায় খড়ের ওপর পাটি, মাদুর, হোগলা বিছিয়ে সকালের মিঠে রোদ পোহানো আর পিঠাপুলি ভোজের দৃশ্য। কবি সুফিয়া কামাল তার ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় গ্রামবাংলার সেই রূপটি চিত্রিত করেছেন- ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’ পিঠা-পায়েসকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত আছে অসংখ্য গান ও ছড়া। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ভাওয়াইয়া গানেও রয়েছে পিঠার প্রভাব- ‘মনটাই মোর পিঠা খাবার চাই।’ পৌষের সন্ধ্যা মানেই পিঠা তৈরির আয়োজন আর সকাল মানেই ভোজন উৎসব। কখনোবা সারা রাত ধরে চলে পিঠা বানানোর পালা। পৌষে এবাড়ি-ওবাড়ি চলে পিঠার নিমন্ত্রণ। জামাই, বেয়াই, বন্ধুবান্ধব বেড়াতে যান পরস্পরের বাড়ি। নিকট আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে পাঠানো হয় পিঠা পায়েশ। মেয়ে বা ছেলের শ্বশুরবাড়িতে উপঢৌকন হিসেবে আলপনা আঁকা মাটির হাঁড়িতে করে পিঠা দেয়া নেয়ার রীতি এখনো হারিয়ে যায়নি বাংলাদেশে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও মানুষে-মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও বন্ধনকে আরো দৃঢ় করে পিঠামেলা উৎসবের আয়োজন। বাঙালির লোক ইতিহাস-ঐতিহ্যের নান্দনিক প্রকাশ-বিকাশে পিঠা-পুলির গুরুত্ব অপরিসীম। গ্রামের পিঠাপুলির জনপ্রিয়তার জোয়ারে এখন ঢেউ ভাঙছে নাগরিক জীবনেও। রাজধানীর ইট-কাঠের জীবনও রাঙিয়ে তোলে পৌষ পার্বণ। রাজধানী ঢাকার অলি-গলি, ফুটপাথে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে পিঠা বিক্রির ধুম। অন্যদিকে গ্রামগঞ্জে পৌষের রাত মানেই ওয়াজ মাহফিল, কীর্তন আর পালাগানের মুখরিত আসর। পৌষ মানেই গ্রামগঞ্জে বাহারি মেলার আয়োজন। প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালিও পৌষ এলে প্রিয়জন আর পিঠাপুলির কথা মনে করে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠেন মান্না দে’র বিখ্যাত গান- ‘পৌষের কাছাকাছি রোদ মাখা সেই দিন, ফিরে আর আসবে কি কখনো? ফিরে আর আসবে কি কখনো!’ পৌষের পাতাঝরা হিম জয় করে বাংলার প্রকৃতিকে রাঙায় সরিষা, ডালিয়া, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, মোরগ, জিনিয়াসহ নানা ফুল। পৌষ শেষে পুরো মাঘ মাসজুড়ে সগৌরবে বিলিয়ে যায় তার সুভাস আর সৌন্দর্যের অফুরন্ত ভান্ডার। শীত এলেই সবুজ-শ্যামল এ বাংলাদেশে এসে পড়ে আমাদের অতিথি পাখিরা। অতিথি আর দেশি পাখিদের কলকাকলিতে এখন মুখর নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাঁওড়। শীতকালে হরেকরকম শাকসবজিতে ভর্তি থাকে হাটবাজার। এই ঋতুতেই মেলে শিং, কৈ, মেনি, শোল ও টাকিসহ নানা স্বাদের দেশি মাছ। মেলে বরই আর কমলালেবু। কিন্তু পয়লা বৈশাখ বা বসন্ত উৎসবের মতো অভ্যর্থনা পায় না পৌষ। শরীরে কাঁপন ধরিয়ে আমাদের প্রাত্যহিক মৃদুমন্দ জীবনে ছন্দপতন ঘটায় বলেই হয়তো এ কার্পণ্য। শীতের এত রঙিন আনন্দের মাঝেও রয়েছে বিষাদের কালো সুর। বিত্তবানদের কাছে সবচেয়ে আরামদায়ক এ ঋতু গরিবের কাছে দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনার। গ্রামগঞ্জে শীতবস্ত্রহীন মানুষগুলো বড় কষ্ট করে অতিবাহিত করে শীতার্ত প্রহর। মধ্যযুগে কবি মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমণ্ডল’ কাব্যেও পাওয়া যায় শীতকষ্টের সে বেদনাবিদুর চিত্র- ‘দুঃখ কর অবধান, দুঃখ কর অবধান/জানু ভানু কৃশানু শীতের পরিত্রাণ।’ ঠান্ডায় প্রাণহানিও শীতকালের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদের দেশেই লাখ লাখ মানুষের কাছে এখনো শীত আসে ভয়াবহ রূপ নিয়ে। প্রতিবছর বন্যা, খরা, ঝড়, বৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে বাংলাদেশের মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নতুন মাত্রা যোগ করেছে শৈত্যপ্রবাহ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে উত্তরাঞ্চলে শীত বরাবরই বেশি। হিমালয় পাদদেশীয় এই অঞ্চলে শীত দুর্যোগ হয়ে আবির্ভূত হয়। তার ওপর ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ধরলা, তিস্তা পাড়ের মানুষের অভাব অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি। উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠী একটা সময়ে শীতের আগমনের পূর্বাহ্নে ‘কার্তিকের মঙ্গা’ বা দুর্ভিক্ষসম পরিস্থিতির শিকার হতো। ‘মঙ্গা’ অর্থ খাদ্যের অভাব ও দুঃখ দারিদ্র্য। উত্তরাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে প্রতি বছরের কার্তিকের মঙ্গা ছিল একটি কঠিন বাস্তবতা। বর্তমানে মঙ্গার অবসান ঘটেছে কিন্তু জীবনযাত্রার বাড়েনি মান। শৈত্যপ্রবাহের ঝুঁকিমুক্ত নয় এবারের শীতকাল। কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহের ফলে বাস, ট্রেন এবং অভ্যন্তকরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ের পরে যাত্রা করে কিংবা বাতিল হয়ে যায়। ফেরি পারাপারে ঘটে মারাত্মক বিপর্যয়। শৈত্যপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশার কারণে সারা দেশে আলুসহ রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। একটু সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিলে কমানো যেতে পারে স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ কৃষি ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। শৈত্যপ্রবাহ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়ার এখনই সময়। প্রতিবছরই শীত এলে মহতী মানুষ শীতকাতর দরিদ্র মানুষের কাছে সাধ্যানুযায়ী বিতরণ করেন শীতবস্ত্র। আসুন, আমরা দেশের শীতার্ত মানুষকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসি। একটি কাপড় দিয়ে একটি শিশু কিংবা একজন বৃদ্ধকে রক্ষা করি। এছাড়া শীত একদিকে যেমন ভোজন উৎসবের ঋতু, অন্যদিকে ঝরাজীর্ণ, রোগ-শোকের। শীত এলেই ‘কোল্ড ডায়রিয়া’, বমি, জ্বর-কাশি, ব্রঙ্কাইটিস ও শিশুদের নিউমোনিয়া, শ্বাসনালীর তীব্র সংক্রমণ (এআরআই), হাইপোথারমিয়া, রক্ত আমাশয়সহ ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ে। এখনই সময় সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমে শীতকালীন রোগ প্রতিরোধের। সেই সঙ্গে বসন্তের পথ চেয়ে বলি- স্বাগত হিমেল হাওয়া, স্বাগত পার্বণের ঋতু শীত।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.