মুঠোফোনে হানিফের কান্নার শব্দ শোনানো হয় তার স্ত্রী ও স্বজনদের। এ সময় ডিবি অফিসের সামনেই জ্ঞান হারান হানিফের স্ত্রী নাসিমা বেগম। অচেতন নাসিমা বেগমকে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে হুঁশ ফেরান দুই সন্তান ও দেবর। তখন তার শ্বশুর বাদশা মিয়া ঘুষের টাকা নিয়ে ডিবি কার্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করছিলেন।
মর্মস্পর্শী ঘটনাটি মঙ্গলবার দুপুরের। নাসিমার স্বামী মো. হানিফ মানিকগঞ্জ-রংপুর-কুড়িগ্রাম-নাগেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারী রুটের ভাইবোন স্পেশাল সার্ভিসের বাসচালক। গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো ব-১৪-২২০২। সুপারভাইজারের কাছে ইয়াবা পাওয়া গেছে- এ অভিযোগে চালক হানিফকে ধরে নিয়ে ডিবি কার্যালয়ে আটকে রেখে বেধড়ক পেটানো হয়। মুঠোফোনে হানিফের আর্তচিৎকার শোনানো হয় তার মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তানদের। পুলিশের দাবি ছিল এক লাখ টাকা। কিন্তু পুরো টাকা না পাওয়ায় মন ভরেনি ডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার। তিনি হুমকি দেন, হানিফকে চালান করে দেবেন। আরও টাকা দাবি করায় ভয়ে হানিফের স্ত্রী জ্ঞান হারান।
হানিফকে আটকের খবর জানতে পেরে নাসিমা, তার শ্বশুর বাদশা মিয়া, শাশুড়ি হাসিনা বেগম, দেবর মোহাম্মদ আলী, ছেলে ফরিদ ও মেয়ে বৃষ্টি কুড়িগ্রামের ভুরঙ্গামারী থেকে মিন্টু রোডে ডিবি পুলিশের কার্যালয়ের সামনে আসেন। সারা দিন অবস্থান করেন। এদিন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তাদের কান্নাকাটি করতেও দেখা যায়।
হানিফের মা হাসিনা বেগম জানান, তার ছেলে একসময় রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে কাজ করত। এখন বাস চালায়। তাদের বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার ভুরঙ্গামারীতে। রোববার তার ছেলে হানিফকে গাবতলী থেকে ধরে আনে ডিবি পুলিশ। আটকে রাখা হয় দু’দিন। এ সময় তাকে ছাড়ার জন্য এক লাখ টাকা দাবি করেন ডিবি কর্মকর্তা। বাধ্য হয়ে তারা জরুরি ভিত্তিতে নতুন তোলা ঘর বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা জোগাড় করে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন। হাফিফের মা হাসিনা বেগম চোখের পানি ছেড়ে বলেন, ‘ঘর বেচে ৪০ হাজার টেহা দিছি। আবার টেহা চায়। না দিলে আমার বাবারে (হানিফ) নাটির মধ্যে বাইড়াইছে (পায়ের গোড়ালিতে পেটায়) আমি তাগোরে কইছি, বাবা আমার কিছু নাই, তাগরে কইছি তোমার ছোট ভাই তাকে যেভাবে দেখপা, তোমাগো লাগি নফল নামাজ পড়মু, কোরান শরিফ পড়মু, আমি মাইসের দুয়ারে দুয়ারে থাই, কোনো দিনও অন্যায় করি নাই, বাবা নতুন একটা ঘর দিছি, হেই ঘর বেইচ্যা ৪০ হাজার টেহা নিয়া আইছি। পোলাপাইন নিয়া আইছি। ওই যে, আমার স্বামী ভেতরে গেছে। ওই যে গাড়ি। আমার ছেলে ড্রাইবার ও চালায়…। পরিচয় দিছে তার পরও মারছে।’
হাসিনা বেগম আরও বলেন, ‘ওরা কইছে টাকা না দিলে চালান করি দিব। কখন ধইরে তোমার চাচায় (হানিফের বাবা) ভিতরে গেছে। কখনও যায় নাই। এহনতরি ফিরা আসে নাই।’ আর টাকা আছে কিনা জানতে চাইলে হানিফের মা বলেন, ‘টাকা নেই, বাজান আমার ছেলেরে ছাইরা দিলে মাইসেতনে চাইয়া নিমু। চাইয়া নিয়া বাড়িত যামু।’ হানিফের ভাই মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ওনারা (ডিবি) ফোন করছে। ফোন কইরা কইছে এক লাখ টাকা নিয়া আসেন ছাইড়া দিমু। সুপারভাইজার আর হেলফারে মাল টানত। ভাই এসবের কিছু জানত না। সুপারভাইজারের মাইরা চামড়া তুইলা ফেলছে। ভাই ছোট থেকে রাজারবাগে চাকরি করছে। ডাইভারি শিখছে। মান্নান স্যারের পরিচয় দিছে। আসলেও ভাই সম্পূর্ণ নির্দোষ। ভাই এসবের কিছু জানে না। ঘর বেইচ্যা আনা ৪০ হাজার টাকা দেয়া অইছে।’
হানিফের ভাই যখন এ প্রতিবেদকসহ কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, ঠিক ওই সময় একটি ফোন আসে নাসিমার মোবাইলে। তাকে বলা হয় ছাড়তে আরও ১০ হাজার টাকা লাগবে। একথা শুনে নাসিমা বলেন আরও ১০ হাজার…। আর সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারান নাসিমা। তার দেবর, দুই সন্তান মিলে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরান।
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে হানিফকে ছেড়ে দেয় ডিবি পুলিশ। রাতেই তিনি পরিবারপরিজন নিয়ে বাড়িতে ফিরেন। বুধবার হানিফের সঙ্গে কথা বলতে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমারে নিয়া ওরা (ডিবি) যা করছে, বলতেও ভয়। আবার যদি ফাঁসাইয়া দেয়।’ এ কথা বলে হানিফ ফোনের লাইন কেটে দেন।
হানিফের আত্মীয়রা জানান, গাবতলী থেকে ডিবির ইন্সপেক্টর আবদুল কুদ্দুস ভাইবোন স্পেশাল সার্ভিসের বাসচালক হানিফসহ তিনজনেক ধরে নিয়ে যান। তাদের মধ্যে হানিফের কাছে ঘুষ দাবি করে নির্যাতনের অভিযোগ আনা গেলেও বাকি দু’জনের ক্ষেত্রে কী ঘটেছে, কত টাকা রফাদফায় তারা ছাড়া পেয়েছেন, সেটা জানা যায়নি। গ্রেফতারে নেতৃত্ব দানকারী ইন্সপেক্টর আবদুল কুদ্দুস ডিবি পুলিশের পশ্চিম বিভাগে কর্মরত।
হানিফের পরিবারের অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিবি পশ্চিম বিভাগের উপকমিশনার সাজ্জাদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘হানিফ নামে গাবতলী থেকে কোনো আসামিকে আটক করা হয়নি। ৬০০ পিস ইয়াবাসহ একজনকে আটক করে মঙ্গলবার চালান দেয়া হয়েছে।’ হানিফের পরিবারের কাছে টাকা দাবির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাইরে তো অনেকে অনেক কথাই বলে। এ ধরনের কোনো তথ্য আমার জানা নেই।’
ভাইবোন পরিবহনের ভুরুঙ্গামারী কাউন্টারের ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, দুই দিন আগে গাড়িটি ঢাকার ডিবি পুলিশ আটক করে। কেন, কী কারণে আটক করেছে বিষয়টি তাদের জানা নেই। বাবু নামে এক ব্যক্তি ঢাকার আক্তার নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে তাদের নামে গাড়িটি চালাতেন। ওই গাড়িতে মাদকদ্রব্য পরিবহন বা চালককে আটকের বিষয়টি তার জানা নেই।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.