সামনে-পেছনে মোটরসাইকেল। আরোহীদের মাথায় হেলমেট। গরমের মধ্যেই চাদর মোড়ানো একজন আরোহীর। মোটরসাইকেল দুটি থামে একটি মার্কেটের সামনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলির শব্দ, চিৎকার। কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। থমকে যান আশপাশের লোকজন। রক্তে ভেসে যায় মেঝে। কিলাররা বীরদর্পে চলে যায়। এভাবেই একের পর এক ফিল্মি কায়দায় ঘটছে হত্যাকাণ্ড। রক্তাক্ত হচ্ছে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী। দেশের ফুলের রাজধানী খ্যাত এই গদখালী এখন আতঙ্কের জনপদ। ফুল ব্যববসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করেই ঘটছে হত্যাকাণ্ড। হত্যায় জড়িতদের অনেকে গ্রেপ্তার হলেও নাটের গুরুরা রয়েছে পর্দার আড়ালে। যে কারণে রক্তের হোলি খেলা থামছে না কিছুতেই। লাশ হতে হয়েছে উমির আলী, রবিউল ইসলাম, হাসান সরদার, রাহাজ্জান সরদার ও আলমগীরকে। গত ১৩ই অক্টোবর গদখালী ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার ও ফুলচাষি কল্যাণ সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক যুবলীগ নেতা রাহাজ্জান সরদারকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তার আগে হত্যা করা হয় তার ভাই হাসান সরদারকে। এর জের ধরে আলমগীর হোসেন নামের এক ট্রাকচালককে হত্যা করা হয়। এভাবেই চলছে হত্যার পর হত্যা। এসব হত্যাকাণ্ডের হোতারা আড়ালে থাকলেও সম্প্রতি ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)’র তদন্তে প্রকাশ পেয়েছে হত্যারহস্য। এসব ঘটনায় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে চার আসামি। জবানবন্দিতে হত্যার বর্ণনা ও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িতদের নাম প্রকাশ পেয়েছে। জবানবন্দি অনুসারে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জব্বার ও মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছে হাসান সরদার ও তার ভাই রাহাজ্জান সরদার হত্যাকাণ্ড। রাহাজ্জান হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ঝিকড়গাছা নির্বাসখোলা গ্রামের আক্তারুজ্জামান আতার জবানবন্দিতে জানা গেছে, হাসান সরদারকে হত্যার পর মঠবাড়ি গ্রামের আব্দুল জব্বারের ভাই মহিউদ্দিন পালিয়ে থাকতো। ওই সময়ে আব্দুল জব্বারের ভায়রা ভাই আক্তারুজ্জামান আতার বাড়িতে অবস্থান করতো মহিউদ্দিন। গত ৮ই নভেম্বর আতা তার জবানবন্দিতে বলেছে, ‘ হাসানকে খুন করার পর মহিউদ্দিন মাঝে মাঝে তিন-চার দিন করে আমার বাড়িতে থাকতো। আমার বাসায় এসে সে বলে রাহাজ্জান মেম্বারকে মেরে ফেলতে হবে। রাহাজ্জানকে খুন করার জন্য অস্ত্র কিনতে হবে।’ তারপরই যশোরের বেনাপোলের সীমান্তবর্তী বারোপোতা গ্রামের কিলার আবু তালেব ওরফে তালেমকে ডেকে আনা হয়। আক্তারুজ্জামান আতার আত্মীয় তালেম হত্যা, অস্ত্রসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। আতার ঘরে বসেই রাহাজ্জান হত্যার ছক তৈরি করা হয়। কথা হয় অস্ত্র কেনার বিষয়ে। তালেমের কাছ থেকেই ২৯শে সেপ্টেম্বর অস্ত্র কেনা হয়। ওই দিন মোটরসাইকেলযোগে আতা ও মহিউদ্দিন বেনাপোল বারপোতা বাজারে পৌঁছে। সেখান থেকে তালেম ও হাতকাটা বদিয়ার তাদের নিয়ে যায় বাজার সংলগ্ন কলাবাগান ঘেরা একটি বাড়িতে। ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে সেখানে ক্রয় করা হয় ছয় রাউন্ড গুলিসহ একটি কাটা বন্দুক। ওই কাটা বন্দুক দিয়েই হত্যা করা হয় রাহাজ্জান মেম্বারকে। হত্যাকাণ্ডের বর্ণনাও দিয়েছে কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীরা। সেদিন ১৩ই অক্টোবর। সকাল ৭টায় বাসা থেকে বের হয়ে ফুল কেনাবেচা করে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রাহাজ্জান। তার আগে সকাল ৯টায় করিম সরদার মার্কেটের নিরিবিলি সেলুনে সেভ করছিলেন। জবানবন্দি অনুসারে তার আগের দিন থেকেই রাহাজ্জানকে হত্যা করতে খুঁজে বেড়াচ্ছিল এই চক্র। ঘটনার দিন সকাল থেকেই রাহাজ্জানকে অনুসরণ করছিল ফরিদ। ফোনে সেই সংবাদ নিয়েই প্রস্তুতি নেয় কিলাররা। ফরিদ জানায়, রাহাজ্জান সেলুনে আছে। সংবাদ পেয়েই দ্রুত মোটরসাইকেলযোগে ঘটনাস্থলে ছুটে যায় তারা। ডিসকভারি মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিল আলমগীর। মধ্যে ছিল আলমগীর-২। তারপরেই মহিউদ্দিন। পেছনে আরও একটি মোটরসাইকেলে তালেম, আতা। মহিউদ্দিনের কাছে চাদর মোড়ানো অবস্থায় ছিলো কাটা বন্দুক। মোটরসাইকেলটি নাভারণের দিক থেকে গিয়ে করিম সরদার মার্কেটের সামনে থামে। বাজারের ব্যবসায়ীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রুত আরোহীরা নামে। রাহাজ্জান কিলারদের এগিয়ে আসার দৃশ্য দেখতে দেখতেই শুরু হয় গুলিবর্ষণ। গুলিবিদ্ধ রাহাজ্জান মেজেতে লুটিয়ে পড়েন। মুহূর্তের মধ্যেই মোটরসাইকেলযোগে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে কিলাররা। প্রায় একই বক্তব্য প্রকাশ পেয়েছে আলমগীর-২, মশিউর ও সাইফুল ইসলামের জবানবন্দিতে। জড়িতদের ফোনের কল লিস্ট থেকে জানা গেছে, হত্যার ১০-১২ দিন আগ থেকেই তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফোনালাপ হয়েছে। হত্যার পরপর তারা প্রত্যেকে নিজেদের মতো করে আত্মগোপন করে। এসময় তারা ফোন নম্বরও পরিবর্তন করে। তার আগে গত ৫ই জুলাই রাহাজ্জানের বড় ভাই হাসানকে হত্যা করা হয়। নিহতের স্বজনরা জানান, ওই দিন রাতে বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে নিচতলার একটি কক্ষ থেকে হাসানকে বের করে কিলাররা। তারপর তাকে নিয়ে বাড়ির দু’তলায় যায়। উদ্দেশ্য ছিল হাসান ও রাহাজ্জান দুই ভাইকে একসঙ্গে হত্যা করা। সেদিন হাসান চিৎকার করে রাহাজ্জানকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘ভাই, তারা আমাকে মারুক, তুই বের হবি না। ওরা তোকেও মেরে ফেলবে।’ চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন চলে আসতে পারে এই শঙ্কায় দ্রুত হাসানকে গুলি করে কিলাররা। যাওয়ার সময় বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে ঘটাতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এই হত্যা মামলার বাদী ছিলেন রাহাজ্জান। রাহাজ্জানের স্ত্রী আছিয়া খাতুন জানান, রাহাজ্জানকে হত্যার এক সপ্তাহ আগে ফোনে হুমকি দিয়েছিল মহিউদ্দিন। সে বলেছিল যা মন চায় খেয়ে নে। এক সপ্তাহের মধ্যে তোকে শেষ করে দেব। তারপর এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে হত্যা করা হয়েছে। হাসান-রাহাজ্জান হত্যার পর রাহাজ্জান হত্যা মামলার আসামি আলমগীরকে হত্যা করা হয়। ১৮ই অক্টোবর সকালে গদখালী হাটের কালীবাড়ী মাঠ থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। আলমগীর ঝিকরগাছা উপজেলার শরীফপুর গ্রামের সিদ্দিক হোসেনের ছেলে। ঘটনাস্থল থেকে একটি ওয়ান শুটারগান উদ্ধার করে পুলিশ। রাহাজ্জান হত্যা মামলাটি গত ৩রা নভেম্বর থানা পুলিশ থেকে সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। তারপরই গ্রেপ্তার করা হয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জব্বার, আক্তারুজ্জামান আতা, আবু তালেব ওরফে তালেম ও সাইফুল ইসলামকে। তার আগে গ্রেপ্তার করা হয় আলমগীর-২ ও মশিউরকে। কিলিং মিশনে মূল ভূমিকা পালনকারী মহিউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের হোমিসাইডাল স্কোয়াডের উপপরিদর্শক নিউটন কুমার দত্ত বলেন, মহিউদ্দিনসহ জড়িতদের গ্রেপ্তার করতে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে জড়িতদের জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে। সূত্র মতে, ফুল ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই ২০১২ সালে হত্যা করা হয় উমির আলীকে। তারপর থেকে ফুলের হাট নিয়ন্ত্রণ করতেন গদখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল ইসলাম। ২০১৩ তাকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ রাহাজ্জান সরদারকে আটক করেছিল। জেল থেকে বের হয়ে এসে হাটের নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। এভাবেই হাটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এক পক্ষ অন্য পক্ষের লোকজনকে হত্যা করে আসছে। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠেছে ফুল উৎপাদনে শীর্ষে থাকা এই জনপদের কিছু স্বার্থান্বেষীরা। তবে মূল হোতা কারা। কাদের ইন্ধনে ঘটছে এসব হত্যাকাণ্ড। তা এখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে অন্ধকারে থাকলেও এলাকার লোকজনের অজানা নয়। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকেই তা নিয়ন্ত্রণ করে একটি প্রভাবশালী মহল। গদখালী হচ্ছে ফুলের রাজধানী। কথিত আছে, গদখালী ফুলের হাটে টাকা উড়ে। প্রতিদিন ১৫-২০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয় এখানে। ফলে স্থানীয় প্রভাবশালীদের দৃষ্টি এই হাটের ওপর। এই ফুল ব্যবসাকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। যারা চাষিদের কম দামে ফুল বিক্রিতে বাধ্য করে। বেপারিদের কাছে সরাসরি চাষিদের ফুল বিক্রির কোনো সুযোগ এই চক্র দেয় না। তারা কম দামে এবং বাকিতে কিনে বেপারিদের কাছে বিক্রি করে। এখানকার মানুষ এই চক্রের কাছে জিম্মি। ভয়ে মুখ খুলতে চান না তারা। সূত্রমতে, ফুল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের মূল হোতা এক প্রভাবশালী নেতা। কিন্তু তার নাম মুখে আনতে ভয় পান এলাকার লোকজন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এ বিষয়ে অবগত থাকলেও নানা কারণেই ব্যবস্থা নিতে পারছেন না তারা। এসব বিষয়ে আওয়ামী লীগের ঝিগরগাছা থানার সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এসব হত্যাকাণ্ডে রাজনৈতিক শক্তি জড়িত। তবে এর চেয়ে বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.