আগ্রাসনের শুরুতেই আত্মগোপন করেন সাদ্দাম। এর ছয় মাসের মাথায় ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে ধরা পড়েন তিনি।
আটকের পর সাদ্দামকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য একজন বিশেষজ্ঞকে খোঁজ করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।
এই বিশেষজ্ঞের কাজ হবে আটক ব্যক্তিই প্রকৃত সাদ্দাম কি না তা নিশ্চিত করা এবং তাকে জিজ্ঞাসবাদ করে তথ্য বের করা।
ওই বিশেষজ্ঞটি ছিলেন জন নিক্সন।তিনি ১৯৯৮ সালে সিআইএতে যোগদানের পড় থেকেই সাদ্দামকে নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন।
গোয়েন্দা সংস্থাটিতে নিক্সনের কাজই ছিল বিশ্বনেতাদের ভেতরকার খবর যোগাড় করা। এরমাধ্যমে কী সব ব্যাপার তাদেরকে অনুপ্রাণিত ও এগিয়ে রাখে তার বিশ্লেষণ করতেন তিনি।
বুধবার ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসির ভিক্টোরিয়া ডারবিশায়ার প্রোগ্রামে জন নিক্সনকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
জন নিক্সন জানান, ২০০৩ সালে সাদ্দামকে যখন তার জন্মস্থান তিকরিত শহরের খামারবাড়ি সংলগ্ন ভূগর্ভস্থ গর্ত থেকে মার্কিন সেনাদের একটি ছোট দল আটক করে তখন তিনিও ইরাকে ছিলেন।
আগে থেকেই গুজব ছিল, নিরাপত্তার জন্য সাদ্দামের মতো দেখতে একাধিক দ্বৈত চেহারার ব্যক্তি রয়েছে। এ কারণে সাদ্দামকে আটকের খবর পাওয়ার তার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য নিক্সনকে নিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে ২০১১ সালে সিআইএ থেকে চাকরি ছেড়ে দেয়া নিক্সন দুই বছর পর সাদ্দামকে দেখেই চিনে ফেলেন। তিনি বলেন, আমি যখন তাকে দেখলাম তখন আমার মনে কোনো সন্দেহ ছিল না যে তিনিই সাদ্দাম হোসেন।
তিনি বলেন, আমি যখন সাদ্দামের সাথে কথা বলা শুরু করলাম, তখন তিনি আমার দিকে সেভাবে তাকালেন, আমার ডেস্কে থাকা একটি বইয়ে যেভাবে তিনি তাকিয়ে ছিলেন।
বন্দি সাদ্দাম হোসেনকে নিক্সন জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যে অনেক দিন ধরে সাদ্দামকে বিস্তারিত প্রশ্ন করার সুযোগ পান।
এ ব্যাপারে নিক্সন বলেন, বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড মানুষটিকে আমি জিজ্ঞাসাবাদ করছি- এটি বিশ্বাস করতে আমি নিজের গায়ে চিমটি কাটি। এখন ভাবি ব্যাপারটি কত হাস্যকর ছিল।
সিআইএ’র সাবেক এই এজেন্ট ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্টকে নিয়ে ‘ডিব্রিফিং দ্য প্রেসিডেন্ট: দি ইন্টারোগেশন অব সাদ্দাম হোসেন’ নামে বই লিখেছেন। এতে সাদ্দামকে প্রচুর অসঙ্গতিতে ভরা একজন নেতা হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
মার্কিন সংবাদ মাধ্যমে সাদ্দামকে যেভাবে বিকৃতভাবে তুলে ধরা হয়, নিক্সনের বইয়ের বর্ননা পুরোপুরিই আলাদা। তিনি বইটিতে সাদ্দামের মানবিক দিকগুলো তুলে ধরেছেন।
নিক্সন বলেন, আমি এ পর্যন্ত যেসব ক্যারিশমাটিক ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হয়েছি তাদের অন্যতম ছিলেন সাদ্দাম হোসেন। যখনই তার সঙ্গে দেখা হয়েছে তাকে কমনীয়, চমৎকার, মজার এবং নম্র মনে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কোনো কোনো সময় সাদ্দামের চরিত্রের অন্ধকার দিকও ফুটে উঠত। যখন তিনি মেজাজ হারাতেন তখন তাকে ক্রুদ্ধ, রাগী, বাজে, নীচু মনের এবং ভীতিকর মনে হতো।
জিজ্ঞাসবাদের সময়ে দুই থেকে তিনবার সাদ্দামের খারাপ দিকের মুখোমুখি হয়ছেন বলে জানান নিক্সন।
একটি ছোট্ট নোংরা অপরিচ্ছন্ন কক্ষে লোহার তৈরি ভাঁজ করা যায় এমন চেয়ার বসিয়ে ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
ওই সময় কক্ষটিতে নিক্সন, জিজ্ঞাসাবাদকালে লাই ডিটেক্টর ও রক্তচাপ-শ্বাস ওঠানামার তথ্য সংগ্রহকারী তথা পলিগ্রাফার এবং একজন দোভাষী উপস্থিত থাকতেন।
সাদ্দাম একজন নার্সিসিস্ট বা আত্মমগ্ন ছিলেন উল্লেখ করে নিক্সন বলেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট আমার সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করতেন।
নিক্সন জানান, সাদ্দামন হোসেন বেশ কয়েক মাস আত্মগোপনে ছিলেন। এ সময় তিনি খুব একটা কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলেননি।
এ কারণে প্রথম অধিবেশনে নিক্সন সাদ্দামের সঙ্গে এই সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেন যেন তিনি সহযোগিতা করতে রাজি হন। সাদ্দাম জানান, তিনি আলাপ পছন্দ করেছেন।
কিন্তু শুরুটা ইতিবাচক হলেও পরের দিন সাদ্দাম অনেকটা সন্দিগ্ধ হয়ে পড়েন। নিক্সন বলেন, আমার দেখা মানুষদের মধ্যে সাদ্দামই সবচেয়ে সন্দেহপ্রবণ মানুষ। তাকে করা প্রতিটি প্রশ্নের জবাবে তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেন।
তিনি জানান, সাদ্দামকে কথা বলতে উৎসাহিত করার ব্যাপারে সিআইএর দিক থেকে আগ্রহভরে তেমন কিছু বলা হয়নি।
তবে ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে সাদ্দামের নিজের বক্তব্য রেকর্ড করেন নিক্সন। তিনি জানান, সিআইএর ফরমায়েশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে তিনি সাদ্দামকে জিজ্ঞেস করেন। এ ছাড়া তিনি নিজের থেকেও সাদ্দামকে অনেক প্রশ্ন করে তা নিজের ডিভাইসে রেকর্ড করেন। তিনি বলেন, ‘আমি জানতাম আমাকে চেষ্টা করতে হবে এবং জবাব পেতে হবে।’
নিক্সন বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা যারা কাজ করে তাদের শেখানো হয় কিভাবে কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জবাব বের করে তা সম্ভাবনাময় সম্পদে পরিণত করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ইরাকে আগ্রাসন চালানোর জন্য দেশটিতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কথা বলে আসছিল। তাই সাদ্দামকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূণ বিষয় ছিল ‘গণবিধ্বংসী অস্ত্র’।
নিক্সন জানান, হোয়াইট হাউজের প্রধান আগ্রহ ছিল গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিষয়ে। তবে সাদ্দামের সঙ্গে কথা বলে, তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করে এবং বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, সাদ্দাম কয়েক বছর আগেই দেশটির পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এটি নতুন করে শুরু করারও মতলব ছিল না তার।
এদিকে সাদ্দামকে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে জানতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ পাঁচ বছর ধরে নিক্সনকে ডাকেননি। বরং এফবিআইয়ের ভাষ্য ব্যবহার করে হোয়াইট হাউজ। পরে ২০০৮ সালে হোয়াইটহাউজে ডাক পান নিক্সন। তিনি বুশ ও সাদ্দাম- উভয়ের সঙ্গে করমর্দনকারী অল্প কয়েকজন ব্যক্তির অন্যতম ছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট বুশের সমালোচনা করেন। তার মতে বুশ ছিলেন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাকে ঘিরে যেসব উপদেষ্টারা ছিল তারা ‘বিবেচনা বোধহীন এবং জ্বি হুজুর টাইপের’ ছিলেন।
নিক্সন বলেন, সাদ্দামকে উৎখাতের পর ইরাকে কী ঘটবে তার কোনো ধারণাই ছিল না বুশ প্রশাসনের। ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর উত্থানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাদ্দাম ক্ষমতায় থাকলে এই অঞ্চলের জন্য ভালো হতো।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.