তিনবেলা তিন রকম কথায় ক্রিকেটাররা একটু হকচকিত। একবেলার কথা শোনা শেষ না হতেই আরেক বেলার কথা উড়ে আসছে বাতাসে, সেটাও কিনা আবার প্রথম বেলার পুরো উল্টো!
ক্রিকেটারদের দু-একজন খুবই কৌতূহলপ্রবণ। গুরুজনদের কথার ভুল ধরতে নেই জেনেও তাঁরা মাঝেমধ্যে মুখ ফসকে জানতে চেয়ে বসছেন, ‘আচ্ছা, উনি আসলে কী বলেছেন?’ তাঁদেরই মধ্য থেকে তখন দু-একজন বেরিয়ে আসে যাঁরা ফেসবুক, ইউটিউবে ওই সব কথার ভিডিও দেখে পুরো ব্যাপারটা মুখস্থ করে ফেলেছেন। গড়গড়িয়ে সব বলে দিতে পারেন। সেসবের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় বিস্ময়, টিপ্পনী, হাসি-ঠাট্টার পর সবশেষে যোগ হয় হতাশা। ক্রিকেটারদের মুখ থেকে অস্ফুট বেরিয়ে আসে, ‘কারোরই কি ধৈর্য নেই!’
বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই দুধের মাছির দেশ। ক্রিকেটটাও দিনে দিনে তাই হয়ে যাচ্ছে। এখানে দলের সাফল্য উদ্যাপনের লোক ভূরি ভূরি, কিন্তু দুঃখের ভাগ নেওয়ার কেউ নেই। অন্যদের কথা বাদ দিন, ইদানীং তো দেখা যাচ্ছে খোদ ক্রিকেট বোর্ড থেকেই শুরু হয় নেতিবাচক আলোচনা! দলের মধ্যে গ্রুপিং, একজন খেলোয়াড়ের সিরিজের মাঝপথে দেশে ফিরে যেতে চাওয়া বা একজন অধিনায়কের বিশ্বাস করে বলা (পরে অবশ্য এটাকে গুজব বলা হয়েছে) কথা হাটে হাঁড়ি ভেঙে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া—বিসিবির এ রকম হালকা আচরণ কঠিন সময় পার করতে থাকা দলটাকেই কি চাপে ফেলা দিচ্ছে না?
কথাগুলো কে বা কারা বলেছেন, কেন বলেছেন, বুঝে বলেছেন নাকি না বুঝে বলেছেন, সেসব নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কারণ এটা আরও আগে থেকেই হয়ে আসছে এবং মূল সমস্যা কোনো ব্যক্তিকে নিয়ে নয়। অবাস্তব প্রত্যাশার ভেলায় ভেসে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া ভুল ক্রিকেট চিন্তারই অবধারিত পরিণতি এসব চটুল সমালোচনার। ক্রিকেট নিয়ে সবাই যে যার জায়গা থেকে প্রত্যাশার বেলুন ফোলাতে থাকে। কিন্তু সেই বেলুনে কতটুকু গ্যাস ভরতে হবে, সেটা কারও জানা নেই। ফোলাতে ফোলাতে একসময় ঠাস করে বেলুনটা ফেটে যায়। তখন সব দোষ বেলুনওয়ালার।
জাতীয় দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের মতে, নিউজিল্যান্ডে এসে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ দল যে ছয়টি ম্যাচ হেরেছে তার মধ্যে অন্তত তিনটিতে জেতা উচিত ছিল। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটারদের সঙ্গে নিজের ছাত্রদের দক্ষতার কোনো পার্থক্য দেখেন না কোচ। পার্থক্য দেখেন মানসিকতায়, খেলাটার পেছনে মেধা ও বুদ্ধির প্রয়োগে। বাস্তবতাও যে অনেকটা সে রকমই, টেস্ট সিরিজের আগে ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষাতেই সেটা স্পষ্ট। টানা ছয় ম্যাচে হারের পর বেসিন রিজার্ভে সবুজ গালিচায় টেস্ট ক্রিকেট খেলতে হবে এবং সেটাও কনকনে হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে। বিশেষ করে ব্যাটসম্যানদের তো ভয়েই কুঁকড়ে থাকার কথা। কিন্তু বিশ্বাস করুন, কারও মধ্যে এই নিয়ে এতটুকু ভয়-শঙ্কা নেই। পেশাদারি চেহারায় যে ছবিটা থাকা দরকার, সেটা যেন আস্তে আস্তে পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ দল।
একটার পর একটা ম্যাচ হারার পরও বাংলাদেশ দলের এই প্রশংসা অনেকের পছন্দ না-ও হতে পারে। যদিও এটাই সত্যি। ঘরের মাঠে দুই বছর ভালো খেলেছে বলেই দলটা নিউজিল্যান্ডে এসে ধুমধাম ম্যাচ জিতে যাবে বলে যাঁরা স্বপ্ন দেখছিলেন, তাঁরা ক্রিকেটের হাওয়াই-মিঠাই সমর্থক ছাড়া আর কিছুই নন। মুখের ভেতর মিষ্টিটা মিলিয়ে গেল মানেই সব শেষ।
নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ দল টানা ছয় ম্যাচ হেরেছে এবং এর পেছনে ক্রিকেটারদের ভুলের ভূমিকা তো আছেই। কিন্তু ছয় বছর পর অন্য একটি দেশে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে এসেই একটা দল সব প্রতিকূলতা জিতে যাবে, সে আশাটা বাড়াবাড়ি নয়? তাহলে নিজেদের দেশে নিউজিল্যান্ড কী করবে?
আজ থেকে শুরু দুই টেস্টের সিরিজ। খেলোয়াড়েরা তাতে দলীয়ভাবে ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টির চেয়ে ভালো কিছু উপহার দিলে সেটা হবে অলৌকিক। এবং নিশ্চিত থাকুন, সেই অলৌকিক কাণ্ডের কৃতিত্বের সিকিভাগের বেশি মিলবে না ক্রিকেটারদের ভাগে। গুরুজনেরাই সেটা কেড়ে নিয়ে বলবেন, ‘আমরা ওটা করেছিলাম বলেই তো…।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ অভিভাবক বিসিবি। ক্রিকেটে বা দলে কোনো সমস্যা দেখলে তারা অবশ্যই বিষয়টি দেখবে, এর সমাধানও করবে। তাই বলে ‘জনতার মঞ্চে’ দাঁড়িয়ে ক্রিকেটারদের অপমানের শূলে চড়ানোটা অখেলোয়াড়োচিত মনোভাবেরই পরিচয় বহন করে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.