চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে যে কোনো সময় নাশকতা হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। বিদ্যমান দুর্বল নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল নির্বিঘ্নে এমন অঘটন ঘটাতে পারে।
বন্দরে যে কোনো ধরনের নাশকতা ও দুর্ঘটনা এড়াতে তল্লাশি জোরদার ও বন্দরের সল্টগোলা ক্রসিং থেকে চার নম্বর গেট পর্যন্ত পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনাসহ আট দফা সুপারিশ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাটি।
বন্দরে নাশকতার ঝুঁকি সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দর নিরাপত্তা বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এতে যে কোনো মুহূর্তে সরকার ও দেশবিরোধী স্বার্থান্বেষী মহল অর্থের লোভ দেখিয়ে তাদের সহযোগিতায় নাশকতামূলক ঘটনা ঘটাতে পারে। পাশাপাশি বন্দরের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের সীমানা প্রাচীর মোটামুটি উঁচু হলেও বন্দর এলাকায় অবস্থিত সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন ওভারব্রিজ থেকে সহজেই বোমা, ককটেল ইত্যাদি ছুড়ে মারাসহ সহজেই বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটানো সম্ভব। বন্দরের ভেতরে প্রবেশের ১১টি গেটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। কর্মরত শ্রমিকদের ব্যাগ, সিএন্ডএফ প্রতিনিধি ও জেটি সরকারদের ব্যাগ সঠিকভাবে তল্লাশি করা হয় না।
বন্দরে প্রবেশ করা গাড়ি যথাযথভাবে তল্লাশি করা হচ্ছে না। বন্দরের ২১টি জেটিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নাজুক। ছোট ছোট মাছ ধরার নৌকা ও ডিঙি নৌকা প্রায় সময় জেটিগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ে। ওই নৌকার সাহায্যে বন্দরের জেটিতে এবং অবস্থানরত জাহাজগুলোতে নাশকতামূলক ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে রাতের আঁধারে এ ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটানোর সম্ভাবনা বেশি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান যুগান্তরকে বলেন, বন্দরের নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছি। বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সতর্ক অবস্থায় থাকতে বলেছি। তিনি বলেন, বন্দরের নিরাপত্তা জোরদার করতে ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
এদিকে নৌ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার আশংকা প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে বন্দরে বহিরাগতদের অপসারণ করতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় বহিরাগত বা ‘ফালতু’ দ্বারা সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করা সমীচীন নয়।
এতে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল গায়েব, কম্পিউটার পাসওয়ার্ড চুরি, সরকারি তথ্য পাচারসহ কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর অর্থ লোভের ফাঁদে পড়ে যে কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর আশংকা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে যত দ্রুত সম্ভব এসব বহিরাগত/ফালতুদের অপসারণ করতে বলা হয় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে।
বন্দরের বহিরাগতদের প্রবেশের বিষয়টি উল্লেখ করে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈধ নিরাপত্তা পাস ছাড়া মাঝে মাঝে লোকজন বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ করে। বেশির ভাগ সময়ই বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষীরা বিশেষ সুবিধা নিয়ে বহিরাগত ও হকারদের বন্দরের ভেতরে প্রবেশের সুযোগ করে দিচ্ছে। এছাড়া গাড়ি, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান থেকে অবৈধ চাঁদা আদায়ের কৌশল হিসেবে জটলা বাধিয়ে রাখে নিরাপত্তা কর্মীরা। এ সুযোগ নিয়ে দুর্বৃত্তরা প্রবেশ করে নাশকতা চালাতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নিরাপত্তা রক্ষীদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের সংরক্ষিত এলাকায় চুরি, ছিনতাই, বিদেশী নাগরিক ও সিএন্ডএফ এজেন্টকে ছুরিকাঘাতসহ বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ও দুর্ঘটনা বেড়েছে।
বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে বন্দরে ১০-১২ হাজার মানুষ প্রবেশ করে। পাশাপাশি ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন ধরনের গাড়ি ঢুকে চার থেকে সাড়ে চার হাজার। এত বিপুলসংখ্যক মানুষ ও গাড়ি প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকড়িভাবে তল্লাশি করা সম্ভব হয় না।
একেকটি গাড়ি তল্লাশির জন্য সময় পাওয়া যায় গড়ে ৪০-৪৫ সেকেন্ড। এছাড়া নিরাপত্তা কর্মীদের একটি অংশ বেশি বয়সী হওয়ায় তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এমন দুর্বলতার মধ্যেই চলছে বন্দরের কার্যক্রম। এ সুযোগে নানা অপকর্ম ঘটে বন্দর এলাকায়। সম্প্রতি বন্দরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গাড়িতে মদ পাচারের সময় আটক করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, গত এক বছরে বন্দরে রাখা গাছের গুঁড়িতে ১৩ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
বন্দরের নিরাপত্তা দুর্বলতার বিষয় অস্বীকার করে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক যুগান্তরকে বলেন, বন্দরের নিরাপত্তায় দুর্বলতা নেই বললেই চলে। তবে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন এখনও পাইনি। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত করার কার্যক্রম চলছে। পুরো অপারেশন এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, এর আগে গত জুলাই মাসে চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা সচিত্র প্রতিবেদন নৌ মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনেও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি সংক্রান্ত ১০টি বিষয় তুলে ধরা হয়। ওই প্রতিবেদনেও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়েছিল। ওই সুপারিশের আলোকে বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং উচ্চ পর্যায়ের বন্দর নিরাপত্তা কোর কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এসব সুপারিশের অধিকাংশই অদ্যাবধি বাস্তবায়ন হয়নি বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
আট সুপারিশ : বন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে দেয়া গোয়েন্দা সংস্থার আট সুপারিশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- জরুরি ভিত্তিতে নিরাপত্তারক্ষীসহ নিরাপত্তা বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, আনসার সদস্য এবং সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তিদের ভেটিংয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ওভারব্রিজ সংলগ্ন প্রাচীর উঁচু করে তারের ফিন্সিং ওয়াল দেয়া যেতে পারে।
বন্দরের আওতাধীন এলাকা যেমন সল্টগোলা ক্রসিং থেকে চার নম্বর গেট পর্যন্ত সীমানা প্রাচীর উঁচু করা এবং ওই এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা যেতে পারে। এছাড়া বন্দরে গাড়ি প্রবেশের আগে গাড়ির কেবিন বা চালকদের কক্ষে ভালোভাবে তল্লাশি করারও সুপারিশ করা হয়।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.