রবার্ট ব্রাউনের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’। তাতে তিনি একজন রাষ্ট্রনায়কের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। কবিতার একটি প্রধানতম লাইন ‘দাজ আই এন্টারড অ্যান্ড দাজ আই গো’। কবিতায় যাকে দিয়ে কবি কথা বলাচ্ছেন তিনি একজন দেশপ্রেমিক বা প্যাট্রিয়ট। তিনি তার স্বর্ণালী অতীতকে স্মরণ করছেন কবিতায়। এক বছর আগে তিনি যখন শহরে ফেরেন তখন তাকে দেয়া হয়েছিল বিশাল সংবর্ধনা। তার ওপর শহরবাসী গোলাপবৃষ্টি ঝরিয়েছিল। পদতলে ছিল সুগন্ধী পত্রযুক্ত চিরহরিৎ গুল্ম। গির্জার পর গির্জা সাজানো হয়েছিল উজ্জ্বল পতাকায়। বাসাবাড়ির ছাদ ছিল মানুষে পূর্ণ। তারা তাকে একনজর দেখার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। দেশপ্রেমিকের আগমন ঘোষণার জন্য বাজানো হয়েছিল ঘণ্টা। উন্মাদনা যেন সব সীমাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি তিনি চাইলে জনগণ তাকে সূর্যটাও এনে দিতে প্রস্তুত ছিল। তারপর! তারপর সব পাল্টে গেছে। অপকর্মের কারণে দেশপ্রেমিককে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাঁসির মঞ্চের দিকে। এখন আর বাসার ছাদে কেউ নেই। সবাই এখন জানেন কি হতে যাচ্ছে। তার দু’হাত পেছন দিকে বেঁধে বৃষ্টির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাঁসির মঞ্চের দিকে। জনগণ আজ তার দিকে পাথর নিক্ষেপ করছে। তার কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। কি এক নির্মমতা সেই ব্যক্তির জীবনে যিনি সারাটা জীবন কাটিয়েছেন তার দেশের জন্য! তার কথা আজ কেউ শুনছে না। তাই তিনি আক্ষেপভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করেন ‘দাজ আই এন্টারড অ্যান্ড দাজ আই গো’। পরিশেষে তিনি আশাবাদী হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, মৃত্যুতেই সব শেষ হয়ে যায় না। তিনি অন্য জগতে, মৃত্যুর পরে পুরস্কৃত হবেন। রবার্ট ব্রাউনের এই অমর সৃষ্টি দ্য প্যাট্রিয়টকে যেন ভুল প্রমাণ করে দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা। তিনি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন, যেভাবে তিনি হোয়াইট হাউসে অভিষিক্ত হয়েছেন ঠিক একইভাবে তিনি হোয়াইট হাউস থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে যাচ্ছেন শুক্রবার। হোয়াইট হাউসে তিনি ২০০৯ সালে যখন প্রবেশ করেছিলেন তখন তাকে সমর্থন করেছিলেন শতকরা ৬১ ভাগ মানুষ। যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন তার জনসমর্থন শতকরা ৬০ ভাগ। অর্থাৎ ওবামার জনসমর্থনে আঁচ লাগেনি বললেই চলে। তাই তার মধ্যে ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’-এর মতো কোনো অতৃপ্তি থাকার কথা নয়। বলা যায়, তিনি ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’কে ভুল প্রমাণ করে দিলেন। ওবামা বলতেই পারেন ‘ইট ওয়াজ রোজেজ, রোজেজ, অল দ্য ওয়ে’ এবং এর পরেই নিজে বুক উঁচু করে বলতে পারেন- ইয়েট ইট ইজ রোজেজ, রোজেজ, অল দ্য ওয়ে। অর্থাৎ এখনো সারাপথে গোলাপ বিছানো। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যে নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন মাত্র চল্লিশ পেরুনো একজন যুবক হিসেবে তা অনন্য। তিনি যে বয়সে প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অবসরে যাচ্ছেন তাও সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নতুন। শুক্রবার যখন তিনি হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন তার সমর্থনের রেটিং বেড়েছে। তার প্রেসিডেন্সি বা শাসনকে ব্যাপক অর্থে সফল হিসেবে দেখা হয়। বেশির ভাগ মানুষ বলছেন, ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’-এর মতো করুণ পরিণতির শিকার হবেন না তিনি। ওবামা চলে যাওয়ার পর তাকে তারা মিস করবেন। প্রথম দফায় ওবামা ক্ষমতায় আসেন ২০০৯ সালে। ওই বছরের জুনের পর এখন তার জনসমর্থন সবচেয়ে বেশি। সিএনএন/ওআরসির এক জনমত জরিপে তাকে সমর্থন করছেন শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ। বিদায়ী অন্য প্রেসিডেন্টদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় যারা শীর্ষে ওবামা সেই তালিকার প্রায় শীর্ষ স্থান স্পর্শ করেছেন। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের জনপ্রিয়তা ছিল শতকরা ৬৬ ভাগ। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের জনপ্রিয়তা ছিল শতকরা ৬৪ ভাগ। তাদের পরেই রয়েছেন বারাক ওবামা। সিএনএন/ওআরসি’র জরিপে অংশগ্রহণকারীদের দুই-তৃতীয়াংশ (শতকরা ৬৫ ভাগ) বলেছেন, ওবামার প্রেসিডেন্সি ছিল সফল। শতকরা ৪৯ ভাগ মানুষ বলেছেন, ওবামার আছে শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব। বাইরের যে কোনো ঘটনার তুলনায় তিনি নিজের এই ব্যক্তিত্বকে ধরে রেখেছেন। এক-তৃতীয়াংশ (শতকরা ২৫ ভাগ) মানুষ বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে যতজন মহান প্রেসিডেন্ট এসেছেন তার মধ্যে ওবামা অন্যতম। সাবেক প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের প্রতি এমন সমর্থন ছিল শতকরা ১১ ভাগ ও বিল ক্লিনটনের প্রতি এমন সমর্থন ছিল শতকরা ১০ ভাগ মানুষের। তবে শতকরা প্রায় ২৩ ভাগ মানুষ ওবামাকে একজন দুর্বল প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনে করেন। রিগ্যান বা ক্লিনটনকে এমনটা ভেবেছিলেন এর চেয়ে কম মানুষ। তবে সিএনএনের রিপোর্ট অনুযায়ী হোয়াইট হাউস ত্যাগ করার সময়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে দুর্বল প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনে করেছিলেন শতকরা ৪৬ ভাগ মার্কিনি। তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে ডেমোক্রেটদের মধ্যে শতকরা ৫৪ ভাগ মনে করেন ওবামা একজন মহৎ প্রেসিডেন্ট। অন্যদিকে একই সংখ্যক রিপাবলিকানরা মনে করেন ওবামা দুর্বল প্রেসিডেন্ট। তবে ডেমোক্রেটদের মধ্যে ওবামার সমর্থন শতকরা ৯৫ ভাগ। এক্ষেত্রে তাকে সমর্থন করেন শতকরা ১৮ ভাগ রিপাবলিকান। ওবামা যখন প্রথম দফায় প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন তিনি অর্থনীতি, পররাষ্ট্র ও সাম্প্রদায়িক সম্পর্কে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিলেন। এমন ইস্যুতে তার অবদানের জন্য তিনি মার্কিনিদের মধ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এখন শতকরা ৫৭ ভাগ মার্কিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি অনেক ভালো। নির্যাতিত মুসলিম যুবকের পাশে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছেন। তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। টিনেজ আহমেদ মোহাম্মদকে ঘড়ি তৈরি করে স্কুলে যাওয়ার জন্য তাকে পুলিশে দেয়া হয়েছিল। সেই আহমেদকে তিনি হোয়াইট হাউসে ডেকে নিয়েছেন। তার সময়েই আল কায়েদা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করা হয়েছে। এটা তার সময়ে বড় একটি অর্জন বলে মনে করেন সবাই। তিনি কয়েক দশক ধরে কিউবার সঙ্গে শত্রুতাকে বন্ধুত্বে রূপ দিয়েছেন। ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে তাদেরকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত রেখেছেন। এ জন্য তাকে একটি গুলিও ছুড়তে হয়নি। এসব কিছুর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন বারাক ওবামা। ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’-এর মতো করে তার আফসোস করার কিছু নেই। কারণ, তিনি বিজয়ী। ইতিহাসের নির্মাতা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.