উল্লিখিত সব অভিনব প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এবং কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এরই মধ্যে কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। ব্যাংকটির বাকি শাখাগুলোয়ও একই ধরনের অনুসন্ধান চালানোর পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্টরা। এতে কয়েকশ’ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা উদ্ঘাটন হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন তারা। এ মুহূর্তে সারা দেশে কৃষি ব্যাংকের ১ হাজার ৩১টি শাখা রয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা শনাক্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তি প্রদানের সুপারিশ করা হয় পরিদর্শন প্রতিবেদনে। কিন্তু গুরুতর অনিয়মের সঙ্গে জড়িত মূল অপরাধীদের অন্যত্র বদলি, তিরস্কার, ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক, সাময়িক বরখাস্ত ও তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করে তাদের অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় অপরাধীদের লঘু শাস্তি দিয়ে আবারও ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। জড়িতদের বিরুদ্ধে এখনই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা না করলে ব্যাংকটির সার্বিক পরিস্থিতি খুবই নাজুক হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল যুগান্তরকে বলেন, কৃষি ব্যাংকের আজকের পরিস্থিতির জন্য কিছু অসাধু মানুষ দায়ী। অনিয়মের বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
প্রসঙ্গত, সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ নেই। কারণ এগুলো সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। বাংলাদেশ ব্যাংক বড়জোর অপরাধ শনাক্ত করে সুপারিশ করতে পারে। ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু অজানা কারণে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত অধিকাংশ কর্মকর্তা ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারি ব্যাংকে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চুপ থাকে। যখন এ বিভাগ ছিল না, তখন সরকারি ব্যাংকগুলো অনেক স্বচ্ছ ছিল। তার মতে, বিভাগটির পূর্ণ সংশোধন প্রয়োজন। তা না হলে বিলুপ্তি করা হোক।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা হয় ভেঙে পড়েছে, না হয় ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত। কারণ উল্লিখিত প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা অভিনবভাবে দুর্নীতি করেছে। সাধারণত জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে দেয়া অনেক ঋণের প্রমাণ থাকে। পরবর্তী সময়ে সে ঋণ কুঋণে পরিণত হয়। চেষ্টা-তদবির করে এসব ঋণের কিছু আদায় করাও সম্ভব হয়। কিন্তু কৃষি ব্যাংকের ঘটনা পুরোটাই অভিনব। এখানে গ্রাহকের পক্ষে ব্যাংক বিপুল অর্থ পরিশোধ করলেও গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের কোনো পাওনা নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষকের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়ে গেছেন কৃষি ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা। দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচির আওতায় গরু মোটাতাজাকরণের জন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত নিশ্চয়তার বিপরীতে কিছু কিছু শাখায় ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এ ধরনের ৪৪৭টি ঋণের বিপরীতে অর্থের স্থিতি ছিল প্রায় দেড় কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ২ লাখ টাকা। বাকি সব অর্থ যোগসাজশের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের পকেটস্থ করা হয়।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কৃষি ব্যাংকের লোকাল প্রিন্সিপাল অফিস ও সাভার শাখায় ভয়াবহ দুর্নীতি হয়েছে। উভয় শাখার কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে মনো প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিকে প্রায় ৪৩ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে লেটার অব ক্রেডিট বা ঋণপত্রের (এলসি) পণ্য ছাড় করিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ওই গ্রাহকের কাছে ব্যাংকের পাওনার বিষয়টি কোনো হিসাবে দেখানো হয়নি। এ ঘটনাটি ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ঘটেছে। সাভার শাখার দুই ব্যবস্থাপক ও এক কর্মকর্তা এ ঘটনার সঙ্গে জাড়িত। এছাড়া লোকাল অফিস ও আইডি বিভাগের কর্মকর্তারাও সমভাবে দায়ী বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও দুর্নীতির কারণে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া বিপুল অর্থ আদায়ে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন দল। এ প্রসঙ্গে কৃষি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, উল্লিখিত ঘটনায় অপরাধী হিসেবে ১৩ কর্মকর্তাকে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে তিন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কৃষি ব্যাংকের লোকাল প্রিন্সিপাল অফিসের গ্রাহক-এসবিএক্সিমের এলটিআর (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিপটস) বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে নেয়া প্রায় ৩ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে ২০১২ সালের ১৮ জানুয়ারি। সাধারণত সন্দেহ ও মন্দমানের খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার বিধান নেই। কিন্তু সন্দেহ মানের খেলাপি হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠানটিকে একই বছরের ১০ ডিসেম্বর আরও প্রায় দেড় কোটি টাকা ঋণ দেয় কৃষি ব্যাংক। যার পুরোটাই এখন মন্দমানের ঋণে পরিণত হয়েছে।
এছাড়া কৃষি ব্যাংকের কক্সবাজার শাখার গ্রাহক মেসার্স কোয়ালিটি শ্রিম্প প্রজেক্ট ও সাতক্ষীরা হ্যাচারি কয়েক কোটি টাকা ঋণ সুবিধা নিয়ে এখন পুরোটাই মন্দমানের ঋণে পরিণত হয়েছে। একইভাবে বনানী কর্পোরেট শাখার গ্রাহক মেসার্স ম্যাবটেক্স ওয়্যার ধাপে ধাপে প্রায় ৪ কোটি টাকা ঋণ নিলেও প্রায় ৩ কোটি টাকা মন্দ ঋণে পরিণত হয়েছে। এর বাইরে ভল্টের টাকা কর্মকর্তাদের পকেটে ও সঞ্চয়পত্রের টাকা আত্মসাতের মতো ঘটনা রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
এসব ঋণ বিতরণে কোনো ধরনের নিয়ম পরিপালন করা হয়নি। বরং বেশিরভাগ ঋণ অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, কৃষি ব্যাংকের দুর্নীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে, এটা ইতিবাচক। এর আগেও সরকারি ব্যাংকের বেশ কিছু অনিয়ম তুলে এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু সীমিত ক্ষমতার কারণে খুব বেশি ব্যবস্থা নিতে পারেনি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি। বরাবরই সুপারিশ করে আসছে। অজানা কারণে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না সরকার। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উচিত হবে দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা না হলে দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.