পুলিশ কর্মকর্তা বাবা মাহফুজুর রহমান ও মা স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে না বলে মনে করেন তাঁদের মেয়ে ঐশী রহমান। তাঁর প্রত্যাশা, উচ্চ আদালতে আপিলের শুনানিতে তাঁকে খালাস দেওয়া অথবা দণ্ড কমানো হতে পারে। এসব বিষয়ে তিনি কিছু যুক্তিও তুলে ধরেছেন তাঁর আইনজীবীর কাছে।
সম্প্রতি ঐশীর সঙ্গে কারাগারে দেখা করার পর তাঁর আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা এনটিভি অনলাইনকে এসব তথ্য জানান।
অ্যাডভোকেট মাহবুব হাসান রানা আজ বৃহস্পতিবার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ঐশীর মামলায় নিম্ন আদালতের দণ্ডের বিরুদ্ধে করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। ঐশী বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কারাগারে রয়েছে। আমাকে প্রায় সময় কারাগারে তাঁর সঙ্গে আইনি বিষয়ে পরামর্শের জন্য দেখা করতে হয়। গত সপ্তাহে দেখার করার সময় ঐশী আমাকে বলেছেন, কারাগারের কনডেম সেলে একাকী সময় কাটানো কষ্টকর। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টা তাঁকে কনডেম সেলের বাইরে হাঁটতে দেওয়া হয়। অন্য সময় ছোট একটি কক্ষে তাঁর সময় কাটাতে হয়। বিভিন্ন বই পড়ে ও ইবাদত করে দিন পার করেন তিনি।’
‘খাবার হিসেবে কারাগার থেকে যা দেওয়া হয়, তার পাশাপাশি তাঁর চাচা কারাগারের অ্যাকাউন্টে টাকা জমা রাখেন। সেখান থেকে টাকা তুলে কারাগারের ক্যান্টিন থেকে খাওয়া-দাওয়া করেন। এ ছাড়া ছোট ভাইকে তিনি খুব মিস করে। মা-বাবার বিষয়টি নিয়ে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি আমাকে বলেছেন, তিনি পিতা-মাতাকে হত্যা করেননি। নিম্ন আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু তাঁর বিশ্বাস, হাইকোর্টে তিনি খালাস পাবেন। কেননা, আসামি হিসেবে তাঁকে আদালত কিশোরী হিসেবে উল্লেখ করলেও রায়ে প্রাপ্তবয়স্কদের মতো দণ্ড দিয়েছেন। একজন কিশোরীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যায় না। এ ছাড়া বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোনো নারীর ফাঁসি কার্যকর হয়নি। এটা তাঁকে আশান্বিত করে।’
আইনজীবী মাহবুব হাসান রানা আরো বলেন, ‘আপিলে আমরা ২৫টি যুক্তি দেখিয়েছি। তন্মধ্যে অন্যতম যুক্তি হলো মামলার বাদী ঐশীর চাচাকে জেরা করার সময় বলেছেন, তাঁর ভাই নিহত মাহফুজুর রহমান বিয়ে করেছেন ১৯৯৪ সালে। মেয়ে ঐশীর জন্ম হয়েছে ১৯৯৬ সালে। এ ঘটনার সময় ঐশীর বয়স হয় ১৬ বছর। কিন্তু প্রসিকিউশন ১৯ বছর বয়স দেখিয়ে তাঁকে শিশু আইনে বিচার করতে দেয়নি। বাংলাদেশি ফৌজদারি আইন অনুযায়ী তিনি একজন কিশোরী। প্রাপ্তবয়স্ক হতে হলে তাঁর ১৮ বছর দরকার হতো। এ ছাড়া একজন আসামিকে ডিএনএ টেস্ট করার জন্য ছয়টি এক্স-রে করতে হয়। সেখানে ঐশীকে মাত্র তিনটি টেস্ট করা হয়েছে। নিয়মানুযায়ী এসব পরীক্ষার এক্স-রের কপি আদালতে উপস্থাপন না করে শুধু রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে।’
‘এ ছাড়া ২১ নম্বর সাক্ষী ডা. নাহিদ মাহজাবীন মোর্শেদের সাক্ষ্য আমলে নেননি। যিনি তাঁর সাক্ষ্যে বলেছেন, ঘটনার সময় ঐশীর মানসিক ভারসাম্য ছিল না। এক বোতল হুইস্কি খেয়েছিল ঐশী রহমান।’
ঐশীর শুনানি শিগগিরই
এদিকে, ঐশী রহমানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শিগগিরই শুরু হচ্ছে। একই সময়ে শুরু হবে নিম্ন আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ঐশীর করা আপিলের শুনানি। ডেথ রেফারেন্সের শুনানির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে ৭২০ পৃষ্ঠার পেপারবুক। চাঞ্চল্যকর এই মামলার শুনানি এখন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অনুমোদনের অপেক্ষায়।
সুপ্রিম কোর্টের একটি সূত্র জানায়, নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ঐশীর করা আপিল ও রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স আবেদনের শুনানির জন্য ঐশীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদন বিষয়ক (ডেথ রেফারেন্স) ৭২০ পৃষ্ঠার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) সাব্বির ফয়েজ আজ বৃহস্পতিবার এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ঐশীর মামলার পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতি অনুমতি দিলে শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আনা হবে।’
হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখার তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ‘ঐশী রহমানের ৭২০ পৃষ্ঠার পেপারবুকের কাজ শেষ হয়েছে। আমরা কয়েকটি ভাগে দ্রুত সময়ের মধ্যে এই পেপারবুক তৈরি করি।’
গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ২৫টি যুক্তি দেখিয়ে ঐশী রহমান হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন। আপিলে তিনি বলেছেন, তাঁর বিচার প্রক্রিয়া ছিল ভুলে ভরা। মিথ্যা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে তাঁকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বয়সের ক্ষেত্রে মামলার বাদীর বক্তব্য গ্রহণ করেননি আদালত।
মামলার বিবরণে জানা যায়, পুলিশ কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যার দায়ে মেয়ে ঐশী রহমানকে ২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর দুবার মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। প্রত্যেক মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, অনাদায়ে দুই বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর অন্যটি সরাসরি বাতিল হয়ে যাবে।
একই সঙ্গে ঐশীর বন্ধু মিজানুর রহমান রনিকে দুই বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। মামলার অপর আসামি আসাদুজ্জামান জনিকে খালাস দিয়েছেন আদালত। ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহমেদ এ রায় ঘোষণা করেন।
ওই দিন বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ ঐশীর প্রকৃত বয়স প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। আর সে যে সাবালিকা, এটাও প্রমাণ হয়েছে।’ আসামিপক্ষ ঐশীর বয়সের পক্ষে যা যুক্তি দিয়েছে, তা যথাযথ নয় বলে মন্তব্য করেন আদালত।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘ঘটনার দিন ঐশী নেশাগ্রস্ত ছিল। তার ক্রিমিনাল ইনটেন্ট (অপরাধ সংঘটনের ইচ্ছা) ছিল। হঠাৎ করেই কোনো উত্তেজনা ছিল না, পূর্বপরিকল্পিতভাবে সে তার বাবা-মাকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে। সে সুকৌশলে কফির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে।’
পটভূমি
২০১৩ সালের ১৬ আগস্ট রাজধানীর মালিবাগের চামেলীবাগের বাসা থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পরের দিন ১৭ আগস্ট নিহত মাহফুজুর রহমানের ছোট ভাই মো. মশিউর রহমান রুবেল পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার দিন বিকেলে পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করেন ওই দম্পতির মেয়ে ঐশী রহমান। ২০১৪ সালের ৯ মার্চ ঐশীকে প্রধান আসামি করে তিনজনের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক আবুল খায়ের। এ মামলায় বিভিন্ন সময়ে ৪৯ সাক্ষীর মধ্যে ৩৭ জন আদালতে সাক্ষ্য দেন।
২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট আদালতে ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে ঐশী রহমান বলেছিলেন, ‘২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট আমি ছয় পাতা ঘুমের বড়ি কিনেছিলাম। রাত ১১টার পর তিন পাতা বাবার কফিতে মিশিয়ে পান করাই। আর মায়ের কফিতে তিন পাতা মেশাই। কফি পান করার পর তাঁরা ঘুমিয়ে পড়েন। পরে আমি চাকু দিয়ে বাবাকে স্ট্যাব করি। এরপর বাবা মারা যান। বাবাকে হত্যার পর আমি হুইস্কি পান করি। বাবাকে হত্যার পর একইভাবে মাকে চাকু দিয়ে স্ট্যাব করতে থাকি। একপর্যায়ে মা গোঙাতে থাকেন। এরপর মা আমার কাছে পানি চান। আমি তাঁকে পানি খাওয়াই। এরপরও মা যখন মারা যাচ্ছিলেন না, তখন মায়ের গলায় চাকু দিয়ে স্ট্যাব করতে থাকি। পরে মা মারা যান। বাবা-মাকে হত্যার পর কাজের মেয়ে সুমিকে ডাকি। দুজনে লাশ টেনে বাথরুমে রাখি। পরে কৌশলে ছোট ভাইকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই।’
আদালতে ঐশী আরো জানান, মা স্বপ্না রহমানকে হত্যার পর বঁটি দিয়ে চাবির গোছা কেটে চাবি নেন তিনি। এরপর লকারের তালা খুলে নগদ প্রায় লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে সকালে কাজের মেয়ে সুমি, ছোট ভাই ঐহীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। হত্যার পর দেশের বাইরে চলে যাওয়ারও পরিকল্পনা করেন ঐশী।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.