যা চেয়েছি, যা পাবো না -কী চাও আমার কাছে ? -কিছু তো চাইনি আমি । -চাওনি তা ঠিক । তবু কেন এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ? -জানি না । ওদিকে দ্যাখো রোদ্দুরে রুপোর মতো জল তোমার চোখের মতো দূরবর্তী নৌকো চর্তুদিকে তোমাকেই দেখা -সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ? -মনে হয় তুমি দেবী… -আমি দেবী নই । -তুমি তো জানো না তুমি কে ! -কে আমি ! -তুমি সরস্বতী, শব্দটির মূল অর্থে যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি -হাসি পায় শুনে । যখন যা মনে আসে তাই বলো, ঠিক নয় ? -অনেকটা ঠিক । যখন যা মনে আসে- কেন মনে আসে ? -কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না -আশীর্বাদ ! -আশীর্বাদ ? আমার, না সত্যি যিনি দেবী -তুমিই তো সেই ! টেবিলের ঐ পাশে ফিকে লাল শাড়ি আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি, উঠে এসো আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল নোখ দিয়ে চিরে দাও -যথেষ্ট পাগল আছো ! আরও হতে চাও বুঝি ? -তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন শান্তশিষ্ট -না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ? -ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন কাটাতুম তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন -যে জীবন মানুষের ? -আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে তোমাকে দেখার আগে -তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো পলক পড়ে না কী দেখো অমন করে ? -তোমার ভিতরে তুমি, শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে তুমি তারা আড়ালে যে তুমি -সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা -শোন্ খুকী -এই মাত্র দেবী বললে- -একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী- তুই সেই নীরা তোর কাছে আশীর্বাদ চাই -সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি -তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও -কী আছে আমার ? জানি না তো -তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই -সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা তখন তো বলোনি কিছু ? আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা আমারই নিজস্ব–শৈশবের হাওয়া শুধু জানে
-দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ? আমি ধনী হবো -আমার তো দুঃখ নেই–দুঃখের চেয়েও কোনো সুমহান আবিষ্টতা আমাকে রয়েছে ঘিরে তার কোনো ভাগ হয় না আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে ? -তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই ! তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ… তবু সেখানেও শেষ নেই কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি অস্থির দু’হাত দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায় সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি -পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো তোমায় কী দিতে পারি ? -কিছু নয় ! -অভিমান ? -নাম দাও অভিমান ! -এটা কিন্তু বেশ ! যদি অসুখের নাম দিই নির্বাসন না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব দূরত্বের নাম দিই অভিমান ? -কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ? -কী করে ভাবলে যে ভুলবো ? -তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি- এই দৃশ্যে অমরত্ব তুমি তো জানো না, নীরা, আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে । -সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ? -মৃত্যু ? -ছিঃ , বলতে নেই -তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল -পাওনি কি ? -বুঝতে পারি না ঠিক । বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায় শরীরও সে চায় তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ? -ফের পাগলামি ? -দেখা দাও । -আমিও তোমায় দেখতে চাই । -না ! -কেন ? -বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর এ কথা আমি ভয় পাবো । এ শুধুই এক দিকের আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না তুবি এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে– -তুমি কবি ? -তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী -কী চাও আমার কাছে ? -কিছু নয় । আমার দু’চোখে যদি ধুলো পড়ে আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?
–সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.