বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘ব্রেক্সিটের অর্থ ব্রেক্সিট’। কিন্তু তিনি এটাও বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বের হওয়ার একমাত্র পথ লিসবন চুক্তির ৫০তম অনুচ্ছেদ সক্রিয় করার কাজটি তিনি এ বছর করবেন না। তার কয়েকজন মন্ত্রী এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন, ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে (ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর) বা তারও পরে ওই ধারা সক্রিয় করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তবে বৃটিশরা ২৩শে জুনের গণভোটে স্পষ্ট ব্যবধানেই ইইউ ছাড়ার রায় দিয়েছিল। তবে সেই রায় কার্যকরে দেরির কারণ কী? সহজ উত্তর হলো- ইইউয়ের মতো এমন একটি বড় আকৃতির ও নানা ধরনের নিয়মের আওতায় পরিচালিত সংগঠন থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া অসম্ভব জটিল এবং এর জন্য যত বেশি সম্ভব প্রস্তুতি প্রয়োজন। এর চ্যালেঞ্জের কিছুটা অংশ প্রশাসনিক। তেরেসা মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পরই ব্রেক্সিটের জন্য একজন মন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি ডেভিড ডেভিডস। ব্রেক্সিটের গোটা প্রক্রিয়াটি তিনিই সমন্বয় করবেন। এদিকে নতুন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন লিয়াম ফক্স। এই বিভাগটির কাজ হবে ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে ইইউ ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা। আর বরিস জনসনকে দেয়া হয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, যিনি ইইউসহ বাকি বিশ্বের সঙ্গে বৃটেনের সম্পর্কের জন্য দায়ী থাকবেন। ব্রেক্সিটের দরকষাকষি সামাল দিতে এই তিন মন্ত্রী এখন নিজ নিজ মন্ত্রণালয় গোছানো, উপযুক্ত জনবল নিয়োগ নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। স্বভাবতই এর জন্য সময় প্রয়োজন। কিন্তু এর বাইরেও লিসবন চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫০-এর সক্রিয়করণ স্থগিত রাখার শক্তিশালী রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। এই অনুচ্ছেদের ধারাগুলো ইইউ ছাড়ার পক্ষের দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এই ধারা অনুযায়ী ইইউয়ের বাকি ২৭টি দেশ বৃটেনকে ছাড়াই ব্রেক্সিটের শর্তাবলি নির্ধারণ করে নিতে পারবে। এর জন্য কোনো ভোটেরও প্রয়োজন হবে না। আর কোনো দেশের ইইউ ছেড়ে যাওয়ার দুবছরের সময়সীমা কেবল ২৭টি দেশ সম্মত হলেই বাড়তে পারে। আগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাণিজ্যবিষয়ক বিশ্লেষকরা বলছেন, বৃটেন ও ইইউয়ের মধ্যেকার বাণিজ্য চুক্তির শর্তাবলিতে সম্মত হওয়া ও তাতে অনুসমর্থন জানানোতেই দুই বছরের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগবে। ইইউয়ের সঙ্গে অন্য যে ৫৮টি দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে সেগুলো বাদ দিয়েই লাগবে এ সময়। ফলে নতুন বাণিজ্যিক চুক্তিতে উপনীত হওয়া ও অনুচ্ছেদ ৫০-এর সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ার মধ্যে সময়ের পার্থক্য থাকবে। এই সময়ে বৃটেনকে ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশনের নীতি অনুযায়ী চলতে হবে। তাতে করে গাড়ি, রাসায়নিক ও ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্যের মতো অনেক রপ্তানি পণ্যেই শুল্ক যোগ হতে পারে। এই ঝুঁকিকে কমানোর জন্যই অনেকে ব্রেক্সিট প্রক্রিয়াকেই পিছিয়ে দিতে চান। তা সত্ত্বেও অনির্দিষ্টকালের জন্য অনুচ্ছেদ ৫০কে নিষ্ক্রিয় রাখা যাবে না। ব্রেক্সিটের পক্ষের নেতারা ও সিংহভাগ ভোটারই চাইবেন গণভোটের রায়ের প্রতি সম্মান দেখানো হোক। ব্রেক্সিটের প্রক্রিয়া দেরি করানো হলেও অনেকেই সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতে পারেন। কারণ তারা জানেন, ওই গণভোটে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে ও অনেক সংসদ সদস্যই ইইউয়ে থেকে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ইইউয়ের অংশীদাররা ব্রেক্সিটের প্রস্তুতির জন্য তেরেসা মে-কে খানিকটা সময় দিতে চান। তবে তেরেসা মে আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু না করলে তারা প্রকৃতপক্ষে ব্রেক্সিটের শর্তাবলি বা ভবিষ্যৎ বাণিজ্যিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুতই হতে পারবেন। আর তারা দরকষাকষির জন্য শক্তিশালী অবস্থানেই রয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে, ২০১৭ সালের শুরুর মাসগুলোতেই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসাকে অনুচ্ছেদ ৫০ সক্রিয় করার জন্য তীব্র চাপের মুখে পড়তে হতে হবে বলে মনে হচ্ছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.