শেখ মো. নিজাম। যিনি রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ পৌরসভার মেয়র। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে শুরু থেকেই তিনি এ পৌরসভার মেয়র। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মোটা দাগে বড় অভিযোগ, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আইন-কানুনের ধার ধারেন না। টাকা পৌরসভার হলেও খরচ করেন নিজের মর্জিমতো। অগত্যা যা হওয়ার তাই হচ্ছে।
বেশির ভাগ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুধু খাতা-কলমে ঠাঁই পেয়েছে। বাস্তবে প্রকল্পের টাকা চলে যায় মেয়র সিন্ডিকেটের পকেটে। তাই অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তার পিছু ছাড়ছে না। শুধু অডিট আপত্তিই তোলা হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকার। কিন্তু নানা কারণে প্রভাবশালী এ মেয়রের বিরুদ্ধে কথা বলার কেউ নেই। যে কারণে ৮ মাস ধরে অডিট আপত্তির বিষয়টিও ঝুলে আছে। যুগান্তরের মাসব্যাপী অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মেয়রের দুর্নীতি-অনিয়মের চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
পৌর মেয়রের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন খোদ গোয়ালন্দ পৌরসভার দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। দুর্নীতি সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণের নথিপত্র সরবরাহ করে তারা প্রতিবেদককে বলেন, ২১ মার্চ মেয়র শেখ মো. নিজামের সভাপতিত্বে পৌর পরিষদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পৌরসভার কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলররা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় ১৯টি উন্নয়নমূলক প্রকল্প গৃহীত হয়। এর মধ্যে মাটি ভরাটের ১৩টি প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রকল্পে কোনো কাজই হয়নি। সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলররা পৌরসভার রাজস্ব খাতভুক্ত সোনালী ব্যাংক হিসাব (২২০৫০০১০০৪০৪১) থেকে এসব প্রকল্পের নামে ১২ লাখ ৪৪ হাজার ২৬১ টাকা তুলে নেন। ২৪ ফেব্র“য়ারি, ১ মার্চ ও ৭ এপ্রিল তিন দফায় ১৭টি চেকের মাধ্যমে এই টাকা উত্তোলন করা হয়।
প্রকল্পগুলো হচ্ছে- গোয়ালন্দ হাসপাতালের পেছনে পুকুরের পাশে রাস্তায় মাটি ভরাটের কাজ, দেওয়ানপাড়া হাবির বাড়ি থেকে সুলতানের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দ্বারা মেরামত, কুমরাকান্দি বৈশাখী মেলার মাঠের গর্ত ভরাট, জুরান মোল্লাপাড়ার রেলওয়ে রাস্তা হয়ে সাইদুলের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দিয়ে মেরামত, বিলাত আলী মোল্লার বাড়ির সামনে রাস্তার পাশে খাদ মাটি ভরাট, সুইপার কলোনির পেছনের খাদ মাটি ভরাট, কাজীপাড়া রেলওয়ে লাইনের পাশে গর্ত ভরাট, রেলওয়ে কলোনি রাস্তায় মাটি ভরাট, ইদ্রিসিয়া মাদ্রাসার সড়কের পাশে গর্ত ভরাট, আকরামের বাড়ি থেকে জাহিদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দ্বারা সংস্কার, গরু হাটের পাশে গর্ত ভরাট, আদর্শ গ্রাম রাজ্জাকের বাড়ি হয়ে জহিরের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মাটি দ্বারা মেরামত এবং বেড়িবাঁধ থেকে হামিদের দোকান পর্যন্ত রাস্তা মাটি দ্বারা সংস্কার।
পৌরসভার একজন কর্মকর্তা বলেন, বাস্তবে কোনো কাজ ছাড়াই এভাবে ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে প্রকারান্তরে কাউন্সিলরদের ঈদ বোনাস দেয়া হয়। সরেজমিন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোতে গিয়ে কোথাও মাটি ভরাটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। শুধু আদর্শ গ্রাম রাজ্জাকের বাড়ি হয়ে জহিরের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার প্রকল্পে যৎসামান্য কাজ করা হয়েছে।
অন্যদিকে ৩০ জুন অনুষ্ঠিত আরেকটি সভার কার্যবিবরণীতে ৬নং ওয়ার্ডে আরও দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা উল্লেখ করা হয়। এই দুটি প্রকল্প হচ্ছে- পরিচ্ছন্নকর্মী বাসস্থানের (হরিজন কলোনি) পেছনে গর্ত ভরাট এবং একই ওয়ার্ডে ময়সের মাতব্বরপাড়ায় গর্ত ভরাট।
তথ্যানুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, পরিচ্ছন্নকর্মী বাসস্থানের পেছনের গর্ত ভরাটের নামে ৬ জুন সোনালী ব্যাংকের উন্নয়ন খাতের হিসাব থেকে ২২০৫১৯৭৬৯৩৪নং চেকের মাধ্যমে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৭৪ টাকা তুলে নেয়া হয়। একইদিন ওই অ্যাকাউন্ট থেকেই ২২০৫১৯৭৬৯৩৬ নং চেকের মাধ্যমে ময়সের মাতব্বরপাড়ার গর্ত ভরাটের নামেও ১ লাখ ৩৯ হাজার ৮৬০ টাকা উত্তোলন করা হয়। ৩০ জুন সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই টাকা তুলে নেয়া হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, পরিচ্ছন্ন কর্মীর বাসস্থানের পেছনের গর্ত ভরাট হয়নি। হরিজন কলোনির পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শ্যামলাল ভক্ত যুগান্তরকে বলেন, ‘কিসের গর্ত ভরাট প্রকল্প। ভরাট প্রকল্পের নামে মূলত কিছু জায়গা ওয়ার্ড কাউন্সিলর কোমল কুমার সাহা নিজেই দখল করেছেন। এসবই চলছে গোয়ালন্দে।’
একই ওয়ার্ডে ময়সের মাতব্বরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায় গর্ত ভরাট হয়নি। এ সময় সেখানে উপস্থিত এলাকার বাসিন্দা হালিম যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্প নেয়া হলে তো মাটি ভরাট হতো। প্রতি অর্থবছর এরকম ভুয়া প্রকল্প করে পৌরসভার লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কোমল কুমার সাহা যুগান্তরকে বলেন, ‘খুবই কম টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। মাটি যা ফেলানো হয়েছে তা বৃষ্টির পানিতে গর্তে পড়ে গেছে। তাছাড়া ডেইলি লেভারের মজুরি দিয়ে টাকা শেষ হয়ে গেছে।’
তবে কাউন্সিলর কোমল কুমার সাহা প্রকল্পের টাকা তুলে নেয়ার কথা স্বীকার করলেও বেমালুম সব অস্বীকার করেন মেয়র।
যুগান্তরকে মেয়র শেখ মো. নিজাম বলেন, ‘রেজুলেশন হলেই কাজ বাস্তবায়ন হয় এটা ঠিক নয়। অনেক সময় সিদ্ধান্ত নিই অথচ কাজ বাস্তবায়ন করতে পারি না। ওই দুই প্রকল্পে কোনো টাকা ছাড় দেয়া হয়নি।’
সূত্র জানায়, ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত পৌর পরিষদের সভায় জঙ্গল পরিষ্কার ও রাস্তা সংস্কারের নামে ৭টি প্রকল্প গৃহীত হয়। পৌরসভার কর্মচারীদের নামে জঙ্গল পরিষ্কার ও রাস্তা সংস্কার দেখিয়ে ১১টি চেকের মাধ্যমে ২৪ ফেব্রুয়ারি ও ৯ মে ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ৪০ টাকা উত্তোলন করা হয়। যুগান্তরের তথ্যানুসন্ধানে এসব চেকের কয়েকটি নাম্বারও পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রকল্পের একটিতেও কোনো কাজ হয়নি।
উল্লিখিত প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখিয়ে ২২০৫১২১৯৬০০ চেকে ৭১ হাজার ৪৪২ টাকা, ২২০৫১২১৯৫৯৬ চেকে ৭৪ হাজার ২৭৭ টাকা, ২২০৫১২১৯৫৯৪ চেকে ৭০ হাজার ৮৭৫ টাকা, ২২০৫১২১৯৮৫২ চেকে ৭৫ হাজার ৪১১ টাকা, ২২০৫১২১৯৮৫৪ চেকে ৭৭ হাজার ৮৫৬ টাকা, ২২০৫১২১৯৮৫৬ চেকে ৭৫ হাজার ৪১১ টাকা, ২২০৫১২১৯৮৬০ চেকে ৬৭ হাজার ১৯৩ টাকা, ২২০৫১২১৯৫৯৮ চেকে ৭২ হাজার ৫৭৬ টাকা তুলে নেয়া হয়। একইভাবে আরও তিনটি চেকে ৮১ হাজার টাকা তুলে নেয়া হয়।
পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ একজন সাবেক কর্মকর্তা বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে আড়তপট্টি ইজারা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে ইজারাকৃত স্থানের আয়তন হিসাব করে প্রাথমিকভাবে আনুমানিক মূল্য নির্ধারণ করার কথা। বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত মূল্য অনুযায়ী ইজারা না হলে পৌরসভার নিজস্ব জনবল দিয়ে খাজনা আদায়ের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু এসবের কিছুই মানা হয়নি।
২০১৪ সালে গোয়ালন্দ আড়তপট্টি মহালটি ইজারাই দেয়া হয়নি। মেয়র তার নিজস্ব কতিপয় ব্যক্তির কাছ থেকে এককালীন ১০ লাখ টাকা নিয়ে খাজনা উত্তোলনের সুযোগ দেন। পুরো টাকা তিনি পকেটস্থ করেন।
অপরদিকে একইভাবে অনিয়মের আশ্রয় নেন ২০১৫ সালে। এ সময় ছাগল হাট মহালটিও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে তিনি একক সিদ্ধান্তে পছন্দের ব্যক্তির অনুকূলে ইজারা বরাদ্দ দেন। এভাবে বরাদ্দ দেয়ার সময় মোটা অংকের টাকা নেন। তবে টাকার পরিমাণ জানা যায়নি।
উন্নয়ন ফান্ডের টাকায় অনুদান : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পৌরসভার একজন কাউন্সিলর যুগান্তরকে বলেন, ‘উন্নয়ন খাত থেকে লোন নিয়ে মেয়র দান খয়রাত করেন। অথচ পৌরসভার বিধিবিধানে এর কোনো নিয়ম নেই। এমনকি তার নিজের লোকজনকে পুনর্বাসনের জন্য পৌরসভার তহবিল থেকে অনুদান দেন। এরকম অসংখ্য প্রমাণ পৌরসভার রেকর্ডপত্রে রয়েছে।’
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে বলা হয়, সর্বশেষ গত পহেলা বৈশাখ একটি অনুষ্ঠান হয়। এ সময় মেয়র তার পছন্দের লোক মজিবর রহমানকে চেকের মাধ্যমে দুই দফায় তিন লাখ টাকা দিয়ে সহায়তা করেন। একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীকে খুশি করতে পৌরসভার ফটকের সামনে মন্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের ছবি দিয়ে বিলবোর্ড টানানো হয় পৌর তহবিল থেকে।
গত শুক্রবার ওই বিলবোর্ড সরিয়ে জেলার তিন সংসদ সদস্যের ছবি দিয়ে আরও একটি বিলবোর্ড টানানো হয়। এই বিলবোর্ড স্থাপনে সোনালী ব্যাংক গোয়ালন্দ শাখার অপর আরেকটি হিসাব নম্বর (২২০৫০০১০০৬৪৯৭) থেকে ২২০৫৯৫০৯৮৯৭ চেকের মাধ্যমে ৯৫ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়।
সূত্র আরও জানায়, পৌর আইনে আছে কোনোক্রমেই রাজস্ব খাতের টাকা উন্নয়ন ফান্ডে নিয়ে খরচ করা যাবে না। আবার উন্নয়ন ফান্ডের টাকা রাজস্ব খাতে নেয়া যাবে না। কিন্তু মেয়র সরকারের সব নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ হওয়া সরকারের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের ৪৫ লাখ টাকার বিল পরিশোধ না করে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি।
অভিযোগের বিষয়ে মেয়র শেখ মো. নিজাম যুগান্তরকে বলেন, হাটবাজার ইজারার ৪৮ লাখ টাকা বাকি ছিল। এখনও কিছু টাকা বাকি রয়েছে। ফান্ড স্থানান্তর করা হয়েছে পৌরসভার স্বার্থে। তবে এ পর্যন্ত যা হয়েছে সবই পৌরসভার জন্য। আমার ব্যক্তিস্বার্থে কিছুই করিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে ব্যবসা করে চলাফেরা করি। ১৫ বছর ধরে আমরাই রাজবাড়ী জেলার সর্বোচ্চ করদাতা।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.