নারায়ণগঞ্জে আদালতের কাঠগড়ায় আলোচিত সেভেন মার্ডারের মামলার আসামি নূর হোসেনকে কাঠগড়ায় চড় মেরেছে অপর আসামি র্যাবের হাবিলদার এমদাদুল হক। এ ঘটনায় কাঠগড়ায় থাকা আসামী নুর হোসেনের দুই সহযোগি ও র্যাবের কয়েকজন সদস্য হাবিলদার এমদাদকে কাঠগড়াতেই মারধর করেন। এ নিয়ে চরম হট্টগোল ও হৈ চৈ শুরু হয়। পরে আসামীদের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সদস্যরা তাদের নিভৃত করেন। গতকাল শনিবার ৭ খুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মন্ডলকে আসামী পক্ষের আইনজীবীদের জেরার দ্বিতীয় দিনে মধ্যাহ্ন বিরতির সময় আদালতের কাঠগড়ায় ওই ঘটনা ঘটে। মামলার আগের ধার্য তারিখগুলোতে অসুস্থতার অজুহাতে নূর হোসেনকে কাঠগড়ার বাইরে রাখা হলেও গতকাল বিচারক তার আইনজীবীর প্রার্থণা নামঞ্জুর করে তাকে কাঠগড়ায় অন্য আসামীদের সঙ্গে রাখার নির্দেশ দেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মন্ডল আগে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি থাকলেও বর্তমানে তিনি জেলার বিশেষ শাখার পরিদর্শক পদে কর্মরত। দুপুর পৌনে ৩টায় পুনরায় তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা শুরু করেন আসামী পক্ষের আইনজীবীরা। বিকেল পৌনে ৫টায় জেরা শেষ হয়। গতকাল মেজর (অব) আরিফ হোসেনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ ভূঁইয়া জেরা শেষ করার পর মামলার অন্যতম আসামী লে. কর্নেল (অব) তারেক সাঈদ মোহাম্মদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুলতান উজ জামান ও অ্যাডভোকেট শাহাবুদ্দিন তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরা করেন। তবে গতকাল তারেক সাঈদের আইনজীবীরা তাদের জেরা শেষ করতে পারেননি। বিচারক মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মধ্যাহ্ন বিরতির সময় বিচারকের নির্দেশে আদালতের এজলাসের ভেতরেই আসামীদের খাবার সরবরাহ করা হয়। ওই সময় নূর হোসেনের আইনজীবী ২৩ প্যাকেট বিরিয়ানির ব্যবস্থা করেন। হাবিলদার এমদাদুল হক ২ প্যাকেট বিরিয়ানি নিজের কাছে রাখায় একজনের খাবার কম পড়ে। ওই সময় নূর হোসেন কাঠগড়ার ভেতরে থেকেই দেখেন কাঠগড়ার এক কোনায় হাবিলদার এমদাদুল হকের কাছে ২ প্যাকেট খাবার। তখন তিনি এমদাদের কাছে এর কারণ জানতে চান এবং প্রয়োজনে খাবারের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে জানান। এ নিয়ে হাবিলদার এমদাদের সঙ্গে নূর হোসেনের তর্ক বেঁধে যায়। তখন আকস্মিক ভাবে এমদাদ নূর হোসেনকে চড় মেরে বসেন। এ ঘটনার পর নূর হোসেনের সহযোগি আসামী আলী মোহাম্মদ ও মুরতোজ জামান চার্চিল এবং র্যাবের কয়েকজন সদস্য হাবিলদার এমদাদুল হককে মারধর শুরু করে। তখন পুলিশ তাদের নিভৃত করেন। জেরা আসামী মেজর (চাকুরীচ্যুত) আরিফ হোসেনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ ভূঁইয়া তার জেরার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে চান, যখন ট্রলারযোগে লাশ নিয়ে ৩ নদীর মোহনায় ফেলার সময় ট্রলার চালক র্যাব সদস্য আদম আলী ও আবদুস সামাদ প্রতিবাদ করেছিল কিনা? উত্তরে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আদম আলী প্রতিবাদ করলেও মেজর আরিফের ভয়ে আবদুস সামাদ চুপ ছিল। আইনজীবী জানতে চান, ঘটনার দিন র্যাবের ২টি পিকআপ ভ্যান কখন ঘটনাস্থলে চেক পোস্ট বসিয়েছিল? উত্তরে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সকাল সাড়ে ১১টায়। ২টি গাড়িতে কতজন র্যাব সদস্য ছিলেন? উত্তরে তিনি বলেন ১২ জন সশস্ত্র অবস্থায়। প্রথম ঘটনাস্থলে সর্বমোট কয়টি গাড়ি ছিল? উত্তর-৬টি। আইনজীবী তার জেরায় আরো জানতে চান-মেজর আরিফের একাউন্টে টাকা লেনদেনের কোন দালিলিক প্রমাণ পেয়েছেন কি না? উত্তরে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন-না। মেজর আরিফকে ফ্ল্যাট কিনে দেওয়া হয়েছে বলে কোন দালিলিক প্রমাণ পেয়েছেন কিনা? উত্তরে তিনি বলেন-না। সবশেষে মেজর আরিফের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুর রশিদ বলেন-আপনি (আইও) মেজর আরিফকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে জোর পূর্বক আদালতে জবানবন্দি প্রদান করেছেন। উত্তরে তিনি বলেন-সত্য নয়। এদিকে জেরার সময় মেজর (অব) আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার (অব) মাসুদ রানা কাঠগড়া থেকে ইশারার মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশীদ মন্ডলকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। মেজর আরিফের আইনজীবীর জেরার পর লে. কর্নেল তাকে সাঈদ মোহাম্মদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুলতান উজ জামান ও অ্যাডভোকেট শাহাবুদ্দিন জেরা শুরু করেন। তবে গতকাল তারা জেরা শেষ করতে পারেননি। আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, গতকাল মেজর আরিফ হোসেনের আইনজীবীর জেরা সম্পন্ন হয়েছে। জেরা শুরু করেছেন লে. কর্নেল তারেক সাঈদের আইনজীবী। মামলার পরবর্তী তারিখ আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিঙ্ক রোড থেকে নাসিকের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ ৭ জনকে অপহরন করে র্যাব-১১এর একটি টিম। ৩দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর বন্দর উপজেলার শান্তিরচর এলাকা থেকে ৬ জনের এবং পরদিন ১ মে একই স্থান থেকে আরো একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন, নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি এবং অ্যাডভোকেট চন্দন কুমার সরকারের বড় মেয়ের জামাতা ডা. বিজয় কুমার পাল। প্রায় এক বছর তদন্ত শেষে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ওসি মামুনুর রশীদ মন্ডল ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নাসিকের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাব-১১’র সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর (অব) আরিফ হোসেন এবং লে. কমান্ডার (অব) মাসুদ রানাসহ ৩৫ জনকে আসামী করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। আসামীদের মধ্যে ২৩ জনকে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। এখনো পলাতক রয়েছেন র্যাব-১১’র সাবেক ৮ সদস্যসহ মোট ১২ জন। মামলায় ১২৭ জন সাক্ষীর মধ্যে ১০৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। সর্বশেষ সাক্ষী হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য শেষে এখন জেরা চলছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.