দূর থেকে দেখলে মনে হবে কিশোরী মরিয়ম কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আসলে গত চারটা মাস এমনকি ঘুমানোর সময়ও তাকে এভাবেই থাকতে হয়েছে। মালেক নামের এক বখাটের হাঁসুয়ার কোপে ওর কাঁধ থেকে ডান হাতটা প্রায় আলাদা হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকেরা এখন কোনো রকমে তা জোড়া দিয়ে রেখেছেন।
মরিয়ম আক্তার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন ছিল। প্রায় তিন মাস চিকিৎসা শেষে গতকাল সোমবার সেখান থেকে নিজেদের বাড়িতে ফিরেছে সে। ফেরার আগে মা আর মামার সঙ্গে গিয়েছিল আইন ও সালিশ কেন্দ্রে (আসক)। সেখানে তাঁদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। আসক তাঁদের আইনি সহযোগিতা দিচ্ছে।
মরিয়মের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার গোবরাতলা ইউনিয়নের বেহুলা গ্রামে। মামা আবদুল কাদের বলেন, ‘মরিয়মের বাবা কৃষিকাজ করেন। নিজেদের বাড়িঘর নেই। মেয়েটা ভালো ছাত্রী। ক্লাস ফাইভ আর এইটে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বৃত্তিও পেয়েছে। সেই মেয়ের এই হাল। ও এখন লেখাপড়া করবে কী করে? সে কি স্কুলে ফিরতে পারবে? সব কাজই অন্যকে করে দিতে হয়। এসএসসি পরীক্ষা সামনে। কীভাবে কী হবে বুঝতে পারছি না।’
বখাটের এই হামলার ঘটনাটি এ বছরের ২৭ মের। অন্য দিনের মতোই সে বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। চার বন্ধু একই সঙ্গে প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে রসায়ন পড়তে যায়, হেঁটে বাড়ি ফেরে। সকাল সাড়ে আটটার দিকে আচমকা মালেক নামের এক বখাটে হাঁসুয়া নিয়ে মেয়েদের এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। ঘটনাস্থলে মারা যায় এক বন্ধু কণিকা ঘোষ। মরিয়মের কাঁধ থেকে ডান হাত প্রায় আলাদা হয়ে যায়। বাকি দুজনের একজনের কানে ও আরেকজনের মাথার পেছনে আঘাত লাগে। স্থানীয় লোকজন তখনই মালেককে ধরে ফেলে। রক্তে ভাসতে থাকা মরিয়মকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যায় লোকজন।
কথায় কথায় মরিয়ম জানায়, ও চিকিৎসক হতে চায়। এখনো আশা করে ওর হাতটা ভালো হয়ে যাবে। বলে, ‘যখন ঘুমাই পাশ ফিরতে পারি না। নিজে গোসল করতে পারি না। খেতেও পারি না। সবকিছু মা করে দেয়। কোনো যানবাহনে উঠতে পারি না। অসুবিধা হয়। আমার একটা ছোট ভাই আছে। ও আমাকে দেখে শুধু কাঁদে।’
বখাটের হামলার আতঙ্ক এখনো কাটেনি মরিয়মের। বলে, ‘রাতের বেলা ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্ন দেখি, ছেলেটা হাঁসুয়া নিয়ে তাড়া করছে শুধু। কণিকার কথা মনে পড়ে খুব। বন্ধু ছিল। একসঙ্গে একই স্কুলে পড়তাম। ও আর নেই।’ অবশ্য তার অন্য দুই বন্ধু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছে।
মরিয়মের মা শরিফা খাতুন বলেন, মেয়েদের ওপর বখাটেদের হামলার ঘটনায় এলাকার অভিভাবকেরা এখন আতঙ্কিত। বখাটেদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। এত কঠোর শাস্তি হোক, যেন আর কারও প্রাণ না যায়, স্বপ্ন যেন ভেঙে না যায়।
কথাবার্তা শেষে মরিয়ম সবার কাছে দোয়া চেয়েছে। সে এখনো আশা করে তার হাতটা ভালো হবে, সে চিকিৎসক হয়ে তার দরিদ্র বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে।
আসকের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক নীনা গোস্বামী বলেন, ‘মালেক নামের ছেলেটিকে আগেও ভ্রাম্যমাণ আদালত শাস্তি দিয়েছিল। ওই দিনই এলাকার লোকজন ছেলেটাকে ধরে পুলিশের হাতে দিল। কিন্তু অভিযোগপত্র দিল না পুলিশ। এখনো বিচার শুরু হলো না।’
বখাটের হামলায় নিহত কণিকা ঘোষের মা অঞ্জলি ঘোষ চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেন। আসামি মালেক কারাগারে।
মেডিকেল রিপোর্টের জন্য অভিযোগপত্র আটকে আছে বলে জানিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের পুলিশ সুপার মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের সব কাজ শেষ। আজও (সোমবার) পুলিশ ব্যক্তিগতভাবে সিভিল সার্জনের সঙ্গে দেখা করে মেডিকেল রিপোর্ট চেয়েছে।’
মেডিকেল রিপোর্ট দিতে দেরি হওয়ার কারণ কী, জানতে চাইলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সিভিল সার্জন প্রধান মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘রিপোর্ট তো লেখা হয়ে গেছে। পুলিশের হাতে হয়তো পৌঁছেও গেছে বা যাবে।’ মেডিকেল রিপোর্ট দিতে চার মাস সময় লাগল কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টা আমি সেভাবে জানি না, জানার কথাও না। তবে রোগীদের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাঠানোয় কাগজপত্র প্রস্তুত করতে সময় লেগেছে।’
মরিয়ম আক্তার বিএসএমএমইউর অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান নকুল কুমার দত্তের অধীনে চিকিৎসাধীন ছিল। গতকাল সন্ধ্যায় নকুল কুমার দত্ত বলেন, ‘মরিয়মের হাতে জটিল অস্ত্রোপচার হয়েছে। ও যখন প্রথম এসেছিল, তখন হাতের অবস্থা খারাপ ছিল। এখন কিছুটা ভালোর দিকে।’
অবশ্য মরিয়মের স্বজনেরা বলেন, হামলার ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে সে সময় চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর পর আর কোনো সহায়তা পাননি। এখন পর্যন্ত তাঁদের প্রায় ৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আর কেউ খোঁজ নেয় না
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.