দেশে কাঁকড়া রপ্তানির নীতিমালা রয়েছে। এই নীতিমালায় ২০০ গ্রামের পুরুষ এবং ১৩০ গ্রামের কম ওজনের জীবন্ত স্ত্রী কাঁকড়া রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ভার্জিন কাঁকড়ার বিষয় তাতে উল্লেখ করা হয়নি। উল্লেখ নেই হিমায়িত কাঁকড়া বিষয়টিও। এ ছাড়া রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বিমানবন্দরে আসা পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ে কমে যাচ্ছে জীবন্ত কাঁকড়ার ওজনও। ফলে নীতিমালার ফাঁক-ফোকর ও ওজন কমার বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা বিবেচনা না করায় বিমানবন্দরে আটকে যাচ্ছে কাঁকড়া রপ্তানির চালান। গত ২২ ও ২৯শে সেপ্টেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রায় ৩ টন করে অন্তত ৬ টন ওজনের কাঁকড়ার চীনগামী দুটি চালান আটকে দিয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে দেশীয় রপ্তানিকারকরা। এরপর গত কয়েকদিনে চীনের বিভিন্ন আমদানিকারক বাংলাদেশের অন্তত ১৪টি অর্ডার বাতিল করেছে। এসব কারণে রপ্তানির চালান বাতিল হলে দক্ষিণ এশিয়া ও বৃহত্তর এশিয়ার দেশগুলো থেকে প্রধান কাঁকড়া আমদানিকারক দেশ চীনের বাজার হারাবে বাংলাদেশ। বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ও রাজস্ব হারাবে দেশ। এমনই আশঙ্কা দেশীয় রপ্তানিকারকদের। তাই দেড় যুগ আগে প্রণীত নীতিমালাকে যুগোপযোগী করার জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের প্রতি দাবি জানিয়েছে কাঁকড়া রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিল্ড ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির সহ-সভাপতি তপন সরকার মানবজমিনকে বলেছেন, কাঁকড়া রপ্তানির ক্ষেত্রে নীতিমালাগত ও বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য এরই মধ্যে বন মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করা হয়েছে। জানানো হয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরকেও। গত মাসের শেষ দিকে দুটি রপ্তানি চালান বাতিল হওয়ার পর চীনের বিভিন্ন এলাকার একাধিক আমদানিকারক এরই মধ্যে বাংলাদেশের ১৪টি অর্ডার বাতিল করে দিয়েছে। তা চলে গেছে অন্য দেশে। আর জীবন্ত কাঁকড়া শুকিয়ে যাওয়ায় ওজন কমে যাওয়ার বিষয়টি বুঝতে না চাওয়ায় তা যেতে দেয়া হয়নি। কিন্তু কাঁকড়ার চালান বিদেশে যেতে না দিলে দেশের বাজারে না চলায় তা নষ্টই হয়ে যায়। দেশে অপ্রচলিত পণ্যের এই শিল্পটি বাঁচাতে আশা করি সরকার এ বিষয়ে অচিরেই বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে ঢাকা বন বিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ অ্যান্ড কন্ট্রোল ইউনিটের পরিদর্শক অসীম মল্লিক মানবজমিনকে বলেন, কাঁকড়া রপ্তানি নীতিমালায় কিছুটা অসম্পূর্ণতা রয়েছে। তা যুগোপযোগী করার প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। হিমায়িত কাঁকড়ার ওজন ও ভার্জিন কাঁকড়া নিয়ে এতে কিছু উল্লেখ নেই। ফলে মাঠপর্যায়ে দেখা গেছে, কম ওজনে হিমায়িত কাঁকড়া রপ্তানি হলেও জীবন্ত কাঁকড়া আটকে দেয়া হচ্ছে। অল্প কিছু কম ওজনের কাঁকড়ার জন্য দুটি চালান আটকে দেয়ার বিষয়টিও আমি সরজমিনে দেখেছি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর লবণাক্ত নদী, খাল, বিল, ঘের ও সমুদ্রে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমাণে কাঁকড়া উৎপাদন হয়। মাছের ঘেরেও প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদন হয় কাঁকড়া। বাঘেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, খুলনা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন জেলায় তা উৎপাদন হয়। কিন্তু দেশে এই কাঁকড়াগুলোর ব্যবহার মাত্র কয়েকভাগ। ফলে প্রায় অপ্রচলিত পণ্য হওয়ার কারণে উৎপাদিত কাঁকড়ার অধিকাংশ সংগ্রহও হয় না। আবার চীনসহ বিভিন্ন দেশে কাঁকড়ার প্রচুর চাহিদা রয়েছে। চীনাদের খাবারে পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে তা। ফলে ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে কাঁকড়া রপ্তানি শুরু হয়। এরপর থেকে ধীরে ধীরে কাঁকড়ার সংগ্রহ বাড়ে। একপর্যায়ে বাণিজ্যিকভাবেও কাঁকড়ার উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত কাঁকড়ার অন্তত এক চতুর্থাংশ ঘের বা হ্যাচারির চাষাবাদ থেকে আসে। আর ৭০ ভাগ মতো উৎপাদন হয় প্রাকৃতিকভাবে। কিন্তু এসব কাঁকড়ার প্রায় অর্ধেক এখনও আহরণের আওতায় আসেনি। আহরিত ও উৎপাদিত কাঁকড়ার ১০ থেকে ১৫ ভাগ সীমান্ত দিয়ে পাচার হচ্ছে ভারত ও মিয়ানমারে। আরো ১০ থেকে ১৫ ভাগ রপ্তানি হচ্ছে। ৭০ থেকে ৯০ গ্রাম ওজনের হিমায়িত কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে আরো ৫ থেকে ১০ ভাগের কাছাকাছি। আর বিমানযোগে প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ টনের ২৫ থেকে ৩০টি চালান রপ্তানি হচ্ছে। এগুলো জীবন্ত কাঁকড়া। মূলত এক্ষেত্রেই অধিক রাজস্ব পাচ্ছে সরকার। এপথে বছরে ২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হচ্ছে। কিন্তু ভারত ও মিয়ানমারে কাঁকড়া রপ্তানি বিষয়ে তেমন কোনো নীতিমালা বা বিধিনিষেধ না থাকায় সেসব দেশে উৎপাদিত কাঁকড়ার সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া কাঁকড়াগুলোও চীনে রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়া পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও ফিলিপাইনসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশও চীনে কাঁকড়া রপ্তানি করছে। ফলে বাংলাদেশে অপ্রচলিত হলেও কাঁকড়ার আন্তর্জাতিক বাজারেও রয়েছে প্রতিযোগিতা। কিন্তু কাঁকড়া শিকারের পর অনেকক্ষেত্রে তা হ্যাচারিতে মোটাতাজা করার সুযোগও দরিদ্র আহরণকারীদের নেই। তা বিক্রি বা রপ্তানি না হলে অনেক ক্ষেত্রেই নষ্ট হয়ে যায়। সামপ্রতিক বছরগুলোতে ক্রমেই কাঁকড়ার রপ্তানি বেড়ে চলছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে ৫ হাজার ১১৫ টন মতো কাঁকড়া ও ইল ফিশ রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১ কোটি ৫৩ লাখ ৪০ হাজার ৯০৫ মার্কিন ডলার। পরের বছর ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৬ হাজার ৭০ টন মতো তা রপ্তানিতে এসেছে ১ কোটি ৮২ লাখ ৫ হাজার ৯৬৬ মার্কিন ডলার। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ৪৮০ টনে। আয় হয় ২ কোটি ৫৪ লাখ ৪১ হাজার ৮৭৫ মার্কিন ডলার। ক্রমেই তা বাড়ছে। তবে সমপ্রতি আকাশপথে কাঁকড়া রপ্তানিতে এভাবে একের পর এক চালান বাতিল হলে অচিরেই ক্রমবর্ধমান এই রপ্তানি কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছে এই খাতে জড়িতরা। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, এই নীতিমালার পেছনে অবশ্যই সরকারের একটা যুক্তি আছে। অপরিণত কাঁকড়াগুলো যদি মাসখানেক পরে রপ্তানি হতো তাহলে পরিমাণে বাড়ার পাশাপাশি আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্র উপার্জন হতো। তাছাড়া কাঁকড়ার নীতিমালায় কোনো অসম্পূর্ণতা থাকলে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে বসে তা সমাধান করে নিতে পারে। বাংলাদেশ লাইভ অ্যান্ড চিল্ড ফুড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গাজী আবুল কাশেম বলেন, একদিকে হিমায়িত কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে ৭০ থেকে ৯০ গ্রাম ওজনে। অপরদিকে জীবন্ত পুরুষ কাঁকড়া ২০০ গ্রাম ও স্ত্রী কাঁকড়া ১৩০ গ্রামের কম ওজনের হলেই রপ্তানি চালান আটকে দেয়া হচ্ছে। তা এক দেশে একই বিষয়ে দুই নীতি হয়ে গেল না। অথচ অধিকাংশই ক্ষেত্রেই কম ওজনের কাঁকড়াগুলোর বেশির ভাগই ভার্জিন। যার ওজন প্রাকৃতিকভাবে কম থাকে। অপর দিকে সঠিক ওজনের জীবন্ত কাঁকড়া আহরণের পর থেকে বিমানবন্দরে পৌঁছা পর্যন্ত পানি নির্গত ও শুকিয়ে এর ওজন ১০-২০ গ্রাম কমতেই পারে। তা তো প্যাকেট থেকে একটি কাঁকড়া নিয়ে শুকনো অবস্থায় ও পানিতে চুবিতে তারপর মেপে ওজনের ব্যবধানটা যাচাই করা যায়। তা না করেই যুগ অনুপযোগী নীতিমালার দোহাই দিয়ে রপ্তানি চালান বাতিল করে দেয়া হচ্ছে। এতে শুধু রপ্তানিকারক নয়, সরকারও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.