আমেরিকার অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের সর্বাধিক প্রচারসংখ্যার দৈনিক দ্য অ্যারিজোনা রিপাবলিক ১২৬ বছরের পুরোনো সংবাদপত্র। রক্ষণশীল মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক আদর্শের প্রচারক এই পত্রিকা সব সময় রিপাবলিকান দলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছে। প্রকাশনার শুরু থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আমেরিকার প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেই পত্রিকাটি সুস্পষ্ট ভাষায় রিপাবলিকান দলের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে। কিন্তু গত ২৭ সেপ্টেম্বর পত্রিকাটি এক বিরাট ব্যতিক্রমী কাজ করেছে। রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বাদ দিয়ে একদম সোজাসাপ্টা সমর্থন ব্যক্ত করেছে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের প্রতি। পত্রিকাটি সেদিন যে সম্পাদকীয় ছেপেছে, তার শিরোনাম ‘হিলারি ক্লিনটন ইজ দ্য অনলি চয়েস টু মুভ অ্যামেরিকা অ্যাহেড।’ সম্পাদকীয়র শুরুতেই পত্রিকাটি লিখেছে: ‘১৮৯০ সালে প্রকাশনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত অ্যারিজোনা রিপাবলিক কখনো প্রেসিডেন্ট পদের জন্য রিপাবলিকান প্রার্থীর বিপরীতে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানায়নি। কখনোই না। এটা রক্ষণশীল মূল্যবোধ ও রিপাবলিকান নীতি-আদর্শের প্রতি আমাদের গভীর দার্শনিক মূল্যায়নের প্রতিফলন। ‘এই বছর অন্য রকম।
‘২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী রক্ষণশীল নন এবং তিনি (আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার) উপযুক্ত নন।
‘এই কারণেই আমাদের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো অ্যারিজোনা রিপাবলিক প্রেসিডেন্ট পদের জন্য ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থীর প্রতি সমর্থন জানাবে।’
এরপর পত্রিকাটি বর্ণনা করেছে হিলারি ক্লিনটনের কী কী যোগ্যতা আছে, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেই। যেমন পত্রিকাটি বলছে, ‘দেশের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্র যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি রয়েছে, সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন একটা দৃঢ় ও সুস্থির হাত, ঠান্ডা মাথা এবং কোনো কিছু করার আগে সব দিক ভেবেচিন্তে দেখার সামর্থ্য। হিলারি ক্লিনটন এটা বোঝেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বোঝেন না। প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যে ধরনের মানসিক গঠন ও অভিজ্ঞতা প্রয়োজন, হিলারি ক্লিনটনের তা আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেই।
‘হিলারি ক্লিনটন জানেন কীভাবে বোঝাপড়া বা আপস-সমঝোতা করতে হয়; তিনি বুদ্ধিমত্তা ও সৌজন্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দিতে জানেন; তাঁর পরিপ্রেক্ষিত-জ্ঞান আছে। তাঁর আরও আছে ফার্স্টলেডি, সিনেটর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে পাবলিক সার্ভিসের রেকর্ড।’
অবশ্য পত্রিকাটি হিলারির কিছু ভুলত্রুটির কথাও উল্লেখ করেছে। যেমন তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত ই-মেইল সার্ভার ব্যবহার করা ছিল একটা ভুল। একই সময়ে, অর্থাৎ তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ‘ক্লিনটন ফাউন্ডেশন’কে যাঁরা চাঁদা বা অনুদান দিয়েছেন, তাঁরা এর বিনিময়ে সুবিধা নিয়েছেন বলে আমেরিকান সমাজে অভিযোগ উঠেছে। যদিও কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হয়নি, তবু অ্যারিজোনা রিপাবলিক মন্তব্য করেছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারির আরও সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
এ রকম কিছু ভুলত্রুটির কথা উল্লেখ করে পত্রিকাটি বলেছে যে ভুলত্রুটি সত্ত্বেও হিলারি ক্লিনটন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে শ্রেয়। ‘হিলারি অসতর্কভাবে হুটহাট এমন কথা বলেন না, যা আমাদের প্রতিপক্ষদের সাহসী করে তোলে আর আমাদের মিত্রদের ভয় পাইয়ে দেয়। দেশ পরিচালনার ব্যাপারে তাঁর আচরণ পরিপক্ব, দৃঢ়প্রত্যয়ী ও যুক্তিবুদ্ধিসম্মত।
‘তাঁর প্রতিপক্ষ সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না।
‘হিলারি ক্লিনটন চাপের মুখে স্থৈর্য বজায় রাখতে জানেন। তিনি দৃঢ়চেতা। তিনি পরাজয় মানেন না।
‘ট্রাম্প সমালোচনার জবাবে অসহিষ্ণুভাবে এমন সব কথা বলেন, যেন থুতু ছুড়ে মারছেন।
‘এটা আমাদের জাতীয় মর্যাদাবোধের পক্ষে হানিকর।
‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যখন কিছু বলেন, তখন বিশ্ববাসী তাঁর কথায় সারবস্তু প্রত্যাশা করে, হাড়জ্বালানো কিচিরমিচির নয়।’
বিরল ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরও একটা পত্রিকা। সেটা কোনো আঞ্চলিক পত্রিকা নয়, আমেরিকার প্রধান জাতীয় দৈনিক দ্য ইউএসএ টুডে, সারা দেশে যার প্রচারসংখ্যা সবচেয়ে বেশি (২৩ লাখ)। এই দৈনিক পত্রিকার একটা বৈশিষ্ট্য হলো, আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এটি কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয় না। কারণ, পত্রিকাটি মনে করে, তার পাঠকদের মধ্যে নানা মতের ও নানা মূল্যবোধের মানুষ আছে, তাদের একেকজনের অগ্রাধিকার একেক রকম। পত্রিকাটি শুধু তার পাঠকদের সামনে প্রধান প্রধান জাতীয় ইস্যু সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মতামত প্রকাশ করে, কিন্তু বলে দেয় না কোন অগ্রাধিকারগুলো তাদের বেছে নিতে হবে। নির্বাচনে কোনো পক্ষ না নেওয়ার এই নীতিকে ইউএসএ টুডে তাদের ‘নন-এন্ডোর্সমেন্ট পলিসি’ বলে; ১৯৮২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশনার দিন থেকে পরবর্তী ৩৪ বছর পত্রিকাটি এই নীতি মেনে এসেছে। কিন্তু গত ৩০ সেপ্টেম্বর এই নীতি ভেঙেছে। সেদিন পত্রিকাটির সম্পাদনা পরিষদ একটি সম্পাদকীয় ছেপেছে, যার শিরোনাম ‘ট্রাম্প ইজ আনফিট ফর দ্য প্রেসিডেন্সি’।
সম্পাদকীয়র শুরুতেই সম্পাদনা পরিষদ বলেছে, ‘যেহেতু প্রতিটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ভিন্ন প্রকৃতির, তাই আমরা প্রতি চার বছর পর আমাদের নন-এন্ডোর্সমেন্ট পলিসি পর্যালোচনা করে থাকি। আমাদের এই অবস্থান পরিবর্তনের কোনো কারণ কখনো দেখতে পাইনি। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি।’ পত্রিকাটি লিখেছে, সম্পাদনা পরিষদের সব সদস্যই মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য নন। যেসব কারণে তাঁরা সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, সেগুলো ওই সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন প্রথমেই বলা হয়েছে, ট্রাম্প তাঁর প্রার্থিতা ঘোষণার পর থেকে গত ১৫ মাস যেসব কথাবার্তা বলেছেন এবং যে ধরনের আচরণ করেছেন, তাতে তাঁরা বারবার দেখতে পেয়েছেন যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যে ধরনের মানসিক গঠন, জ্ঞানবুদ্ধি, দৃঢ়তা, স্থৈর্য ও সততা প্রয়োজন, ট্রাম্পের মধ্যে তার অভাব রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত আমেরিকার সব প্রেসিডেন্ট যেসব মৌলিক অঙ্গীকার পালন করে এসেছেন, ট্রাম্প সেগুলোর প্রতি অবিশ্বস্ততা প্রকাশ করেছেন। এসব অঙ্গীকারের মধ্যে রয়েছে ন্যাটোর মিত্রদের প্রতি অবিচল সমর্থন জোগানো, অবিরামভাবে ও দৃঢ়তার সঙ্গে রুশ আগ্রাসনের বিরোধিতা করে যাওয়া এবং এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা দেওয়া যে যুক্তরাষ্ট্র তার ঋণের অর্থের সদ্ব্যবহার করবে। ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্বৈরশাসকদের সম্পর্কে বিরক্তিকর ধরনের প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করেছেন; তিনি দেখিয়েছেন যে সাংবিধানিক সুরক্ষার প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার অভাব আছে।
ট্রাম্প খামখেয়ালি: নির্বাচনী প্রচারণাযুদ্ধে নামার অল্প কিছুদিন আগে থেকে এ পর্যন্ত তিনি ২০টি প্রধান ইস্যুতে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেছেন ১২৪ বার। অর্থাৎ তিনি কখন কী বলেন, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তিনি পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তা থেকে বোঝা যায় যে এ বিষয়ে তাঁর জানাশোনা খুবই কম। সুতরাং আমেরিকার কমান্ডার ইন চিফ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি তাঁর নেই। ট্রাম্প জাত্যভিমান, গোঁড়ামি ও বিদেশিবিদ্বেষের কারবারি। তাঁর ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড স্বচ্ছ নয়। তিনি কথাবার্তায় বেপরোয়া ও অবিবেচক। একজন ‘সিরিয়াল লায়ার’।
ট্রাম্পের এত সব নেতিবাচক দিক তুলে ধরার পর ইউএসএ টুডে তার সম্পাদকীয়তে বলেছে, নির্বাচনী প্রচারণায় ট্রাম্প যেসব ইস্যু কাজে লাগাতে চাইছেন, সেগুলোর দিকে পত্রিকাটির মনোযোগ নেই, এমন নয়। একই সঙ্গে পত্রিকাটি বলেছে, সম্পাদনা পরিষদের সর্বসম্মতিক্রমে ট্রাম্পকে ‘আনফিট’ ঘোষণা করলেও হিলারি ক্লিনটনের প্রতি সমর্থন জানানোর ক্ষেত্রে তাঁরা সবাই একমত হতে পারেননি।
অ্যারিজোনা রিপাবলিক ও ইউএসএ টুডের ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তের খবর গোটা আমেরিকার মূলধারার সংবাদমাধ্যমে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বিশেষত অ্যারিজোনা রিপাবলিক-এর সম্পাদকীয়টি প্রকাশের পরদিন নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, হাফিংটন পোস্ট, লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসসহ খ্যাতিমান প্রায় সব সংবাদপত্রেই গুরুত্বের সঙ্গে খবরটি ছাপা হয়েছে। আমেরিকায় এটা একটা চাঞ্চল্যকর খবরই বটে। কারণ, দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো নির্বাচনের সময় প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও প্রার্থীদের পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়, এটা সবাই জানে। যেমন নিউইয়র্ক টাইমস সব সময় সমর্থন করে ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থীকে। এবারও পত্রিকাটি সম্পাদকীয় লিখেছে ‘হোয়াই ডোনাল্ড ট্রাম্প শুড নট বি প্রেসিডেন্ট’ শিরোনামে। এতে কিন্তু আমেরিকায় কেউ অবাক হয়নি। আমেরিকান পত্রিকাগুলো প্রকাশ্য রাজনৈতিক পক্ষপাতের জন্য পাঠক-দর্শক হারায় না, কারণ আমেরিকান সমাজ দীর্ঘকাল ধরে এতেই অভ্যস্ত।
কিন্তু একই সংবাদপ্রতিষ্ঠান এক নির্বাচনে এই দলকে, পরের নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ দলকে সমর্থন দেবে—এই ধরনের ঘটনা আমেরিকায় খুব একটা ঘটে না। অ্যারিজোনা রিপাবলিক এবার এই ব্যতিক্রম ঘটিয়েছে বলেই এ পত্রিকাকে নিয়ে গোটা আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে এমন চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস খবর দিয়েছে, অ্যারিজোনা রিপাবলিক নীতি পরিবর্তনের মাশুল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুনতে শুরু করেছে। পত্রিকাটির পাঠক ক্রুদ্ধ হয়ে টেলিফোন করে সাবস্ক্রিপশন বাতিল করতে বলছেন। এমনকি হত্যার হুমকিও নাকি দেওয়া হয়েছে।
অ্যারিজোনা রিপাবলিক কিছু পাঠক হারাতে পারে, কিন্তু ইউএসএ টুডে হয়তো তেমন বড় সমস্যায় পড়বে না। কারণ, আমেরিকান সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তিনি যখন রিপাবলিকান দলের প্রার্থিতা পাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমে প্রচুর উল্টাপাল্টা বকছিলেন, তখন তিনি সংবাদমাধ্যমে জায়গা পাচ্ছিলেন বেশি। কারণ, আমেরিকান সাংবাদিকেরাও চাঞ্চল্যের পেছনেই বেশি ছোটেন; যত উদ্ভট কথা, তত বড় খবর—এই নীতির সাংবাদিকতা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রিপাবলিকান দলের প্রার্থিতা পাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রার্থিতা নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই সংবাদমাধ্যমে তাঁর প্রচার কমতে থাকে। আর যেসব প্রচার তিনি পেতে থাকেন, তাতে গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসে তাঁর ঘোষিত বিভিন্ন পলিসির কথা, তাঁর চরিত্র, জ্ঞান, বিদ্যাবুদ্ধি, সততা ইত্যাদি প্রসঙ্গ। ফলে তাঁর সম্পর্কে প্রচারণায় নেতিবাচক সুর ক্রমেই বাড়তে থাকে।
এভাবে আমেরিকান সাংবাদিকতা এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। চটুল, চাঞ্চল্যকর সাংবাদিকতা এখন প্রবেশ করেছে গম্ভীর ও গুরুতর পর্যায়ে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বলে কথা।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.