রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টির দুই ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মাইক পেন্স ও টিম কেইন গত মঙ্গলবার তাঁদের জন্য নির্ধারিত একমাত্র নির্বাচনী বিতর্কে মিলিত হন। সব পক্ষই একমত, এ বিতর্কে বিজয়ী হয়েছেন ট্রাম্পের সহযোগী রিপাবলিকান প্রার্থী পেন্স। তবে তাঁরা বলছেন, পেন্স ভালো করলেও তা তাঁর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্পকে রক্ষা করার মতো নয়। ভার্জিনিয়ার লংউড বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ৯০ মিনিটের এই বিতর্কের গোড়া থেকেই হিলারির রানিং মেট কেইন বারবার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কঠোরভাবে আক্রমণ করেন। আয়কর হিসাব দাখিলে ট্রাম্পের অস্বীকার, রাশিয়ার পুতিনকে নায়কোচিত সম্মান, জঙ্গি সংগঠন আইএসকে মোকাবিলায় কোনো কার্যকর প্রস্তাব দিতে ব্যর্থতা এবং অভিবাসন প্রশ্নে ঢালাওভাবে মেক্সিকানদের প্রতি বিষোদ্গার ও মুসলিমদের দেশে ঢুকতে দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের যোগ্যতা নিয়ে তিনি পেন্সকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে ফেলেন। বোঝাই যাচ্ছিল, কেইন একটি পরিকল্পনা নিয়ে এসেছেন এবং প্রথম থেকেই সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছেন। তাঁকে মনে হচ্ছিল অতি-ব্যগ্র, অতি উৎসাহী কলেজ বিতর্কে অংশগ্রহণকারী একজন ডিবেটর, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সব রসদ নিজের ঝোলায় ভরে এনেছেন। প্রথমার্ধে তিনি পেন্সের কথার মাঝে কথা বলার চেষ্টা করেন। অন্যদিকে পেন্স ঠিক করে এসেছিলেন ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করবেন। তাঁর বিতর্কিত কোনো বক্তব্য বা অবস্থান সঠিক প্রমাণে চেষ্টা করবেন না। তার বদলে নিরাপত্তা থেকে বৈদেশিক নীতি—উত্থাপিত প্রতিটি প্রশ্নে নিজের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরবেন। আগের সপ্তাহে হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে প্রথম বিতর্কে ট্রাম্প ব্যক্তিগত খোঁচার সম্মুখীন হয়ে বারবার খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন। পেন্স তেমন ভুল করেননি। টিম কেইন শুরুতে জানান, তাঁর ছেলে এখন সেনাবাহিনীতে, এই বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিলারি ক্লিনটন হলে তিনি আশ্বস্ত হবেন। কারণ তিনি অভিজ্ঞ, ধীর-স্থির। অন্যদিকে ট্রাম্প অনভিজ্ঞ, অস্থিরমতি, বিশ্বরাজনীতি বিষয়ে স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন। কিন্তু ট্রাম্প যদি সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হন, তাহলে পুত্রের চিন্তায় তাঁর রাতের ঘুম হারাম হবে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের উদাহরণ দিয়ে কেইন দর্শকদের স্মরণ করিয়ে দেন, তিনি একজন একনায়ক, দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে গলা টিপে হত্যা করেছেন এবং নির্দ্বিধায় প্রতিবেশী ইউক্রেন আক্রমণ করেছেন। সেই পুতিনকেই ট্রাম্প বারবার প্রশংসা করেছেন এবং ওবামার চেয়ে অধিক যোগ্য প্রেসিডেন্ট বলে অভিহিত করেছেন। জবাবে পেন্স পুতিনকে ‘এক পুঁচকে বোম্বেটে নেতা’ হিসেবে বাতিল করে দেন এবং রাশিয়ার প্রতিটি আক্রমণাত্মক প্ররোচনার বিরুদ্ধে আমেরিকাকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে বলে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, মস্কো যেভাবে আসাদ সরকারের পক্ষে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে তার সমুচিত জবাব দেওয়া। গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সিরিয়ায় শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তিনি সিরিয়ার নাগরিকদের জন্য সুরক্ষিত নগর বা সেফ হেভেন প্রতিষ্ঠা ও ‘নো-ফ্লাই জোন’ নীতির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। পেন্সের এই বক্তব্য রিপাবলিকান মূলধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হলেও ট্রাম্পের অবস্থানের ঠিক বিপরীত। রিপাবলিকান নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ টিম মিলার পেন্সের জবাব শুনে তাৎক্ষণিক এক টুইটারবার্তায় বলেন, রাশিয়া ও সিরিয়া প্রশ্নে পেন্স যা বললেন তা চমৎকার। সমস্যা হলো, এই অবস্থান ট্রাম্পের নয়, হিলারির। নারী ও অভিবাসন প্রশ্নে ট্রাম্পের বক্তব্য তুলে কেইন তাঁকে প্রশ্ন করেন, এমন একজন মানুষকে আপনি কী করে সমর্থন করতে পারেন? জবাবে পেন্স প্রথমে ট্রাম্পকে সমর্থন করতে প্রস্তুত বলে জানান। কিন্তু পর মুহূর্তেই হিলারি ক্লিনটনের সমালোচনায় ডুবে যান। কেইন যখন নারী, মেক্সিকান ও মুসলিমদের ব্যাপারে ট্রাম্পের নিজের কথা তুলে ধরেন, পেন্স প্রথমে ‘ট্রাম্প সেসব কথা বলেননি’ বলে সব হেসে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন, ট্রাম্প খুব পরিশীলিত একজন রাজনীতিক নন। ট্রাম্পের আয়কর হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ না করার বিষয়টি কেইন বারবার তোলার চেষ্টা করেন। জবাবে পেন্স ব্যবসায়ী হিসেবে ট্রাম্পের সাফল্যের ফিরিস্তি তুলে ধরেন, কিন্তু ট্রাম্প তাঁর আয়কর হিসাব প্রকাশ করবেন কি না, সে প্রশ্ন পুরোপুরি এড়িয়ে যান। পেন্স যে উত্থাপিত প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না, একপর্যায়ে বিতর্কের সঞ্চালক এলেন কিহানো সে কথা মনে করিয়ে দিতে বাধ্য হন। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের ধারণা, পেন্সের লক্ষ্য ছিল ২০১৬ সালের নির্বাচন নয়, ২০২০ সালের নির্বাচনের জন্য নিজের ক্ষেত্র তৈরি করা। পেন্সের এই রণকৌশল তাঁর জন্য কার্যকর হলেও দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ট্রাম্পের কোনো উপকারে এসেছে, তা মনে হয় না। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর ডানা মিলব্যাঙ্ক মন্তব্য করেছেন, এই বিতর্কে পেন্স যেভাবে বিভিন্ন প্রশ্নে রক্ষণশীল অবস্থান তুলে ধরেন, তাতে রিপাবলিকান দলের অনেকেই তাঁকে মনোনয়ন না দিয়ে ট্রাম্পকে কেন দেওয়া হলো, তা ভেবে নিজেদের হাত কামড়াচ্ছেন। ৯০ মিনিটের এই বিতর্কে তার্কিক হিসেবে পেন্স নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সক্ষম হলেও ভোটারদের মতামত খুব বেশি বদলাতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। গত এক সপ্তাহ ট্রাম্পের জন্য খুব খারাপ গেছে। এই বিতর্কে পেন্সের সহজ বিজয়ের ফলে সে রক্তক্ষরণ সামান্য হলেও বন্ধ হবে বলে রিপাবলিকানরা আশা করছেন। আগামী রোববার, ৯ অক্টোবর, ট্রাম্প ও হিলারি তাঁদের দ্বিতীয় বিতর্কে মিলিত হবেন। সে বিতর্কে ট্রাম্প যদি ফের ব্যর্থ হন, তাহলে পেন্স এই বিতর্কের মাধ্যমে যে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন, তার সবটাই মাঠে মারা যাবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.