হাতের তোয়ালে ছুড়ে ফেলছেন মাটিতে, সঙ্গে ডাগআউট চেয়ারে আছড়ে পড়ছে সজোর পদাঘাত! জিততে আর চাই দুই, সূর্যকুমার যাদবের বাউন্ডারিটা এখনই বিলবোর্ডে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। অবিশ্বাস্য, চরম অবিশ্বাস্য একটা ম্যাচ জিততে চলেছে কেকেআর। সে ঠিক আছে। কিন্তু গৌতম গাম্ভীরের এত আক্রোশ কেন?ইউসুফ পাঠানকে আসতে দেখা মাত্র পাগলের মতো একটা দৌড় শুরু করলেন তিনি। ফুটছেন, ছুটছেন, দীর্ঘদেহী পাঠানকে জড়িয়ে ধরছেন তীব্র আবেগে। পিঠে চাপড় পড়ছে তো পড়েই চলেছে। মুষ্টিবদ্ধ হাতের
ঝাঁকানি যে সেই শুরু হয়েছে, শেষের আর নাম নেই।
ম্যাচ জেতানো নায়ককে দেখলে যে কোনও অধিনায়কই খুশি হবেন। কিন্তু তা বলে তার মতো? গৌতম গাম্ভীরের মতো? এতটা?
কেকেআর ডাগআউটকে এখন ঠিক আর ডাগআউট বলা যাবে না। ওটা অনেকটা এখন অষ্টমী রাতের ম্যাডক্স স্কোয়্যার। কুচকুচে কালো মাথার গিজগিজে ভিড়। যে পারছে, যে ভাবে পারছে, ওই জটলার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আরে, ওটা কে? পীযুষ চাওলা না? সে হোক। কিন্তু তাকে কোলে তুলে ফেলছেন কে? গৌতম গাম্ভীর তো! আর ডাগআউটের বাকি চরিত্র যার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে একে একে, সেটাও তো গৌতম গাম্ভীর!
ম্যাচের মহানায়ক ইউসুফ পাঠানই তো? নাকি তিনি— গৌতম গাম্ভীর!
আবেগের স্ফূরণ, বহিঃপ্রকাশের রামধনু রং দেখলে সব গুলিয়ে যেতে বাধ্য। কেকেআর অধিনায়ককে ঘিরে একটা প্রচলিত প্রবাদ হল, তিনি বড় একটা হাসেন না। লম্ফঝম্ফ দূরের গ্রহ। জিতলেও বিশেষ প্রতিক্রিয়া তার থেকে পাওয়া যায় না। কিন্তু আজ? সোমবার চিন্নাস্বামীর গাম্ভীরের হলটা কী? রাসেল-পাঠান যখন ক্রিজে, ব্রডকাস্টারের ক্যামেরা একবার প্যান করলো তার দিকে।
ম্যাচ শেষ হতে তখনও বেশ দেরি। কেকেআর জিতবে না হারবে, বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু যা দেখা গেল, নিজ-দৃষ্টিকে বিশ্বাস হবে না। কেকেআর ক্যাপ্টেন হাসছেন! পরেরগুলো? উপরেই বলা পরপর। যেখানে অনর্গল হাসি, টিমমেটকে কোলে তুলে নেওয়া, উত্তেজিত হয়ে পড়া সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
হবে না-ও বা কেন? এটা তো কেকেআর ক্যাপ্টেনের কাছে আর পাঁচটা ম্যাচ নয়। চিন্নাস্বামীতে আরসিবি ম্যাচ মানে, বিরাট কোহালি নামক এক ক্রিকেট-সিংহের ডেরায় ঢুকে তাকে বধ করে আসার দিবাস্বপ্ন
দেখা। ঐতিহাসিক ভাবে আইপিএলের এই যুদ্ধ বরাবর বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ ঘটিয়ে থাকে। ইডেন হোক বা চিন্নাস্বামী— যেখানেই দেখা হোক আরসিবি-কেকেআরে কিছু না কিছু নিয়ে লেগেছে। চিন্নাস্বামী দেখেছে দুই অধিনায়কের প্রকাশ্য ঝামেলা।
গাম্ভীর বনাম বিরাট সে বার আর একটু হলে ন্যক্কারজনক দিকে চলে যাচ্ছিল। আবার গত বছরের ইডেনকে ধরা যাক। সরফরাজ খানের সঙ্গে কেকেআরের রবিন উথাপ্পার তীব্র গালিগালাজের সঙ্গে প্রায় হাতাহাতি বেধে যাওয়া, এখনও ভোলা তো যায়নি। তার উপর এই ম্যাচ, গৌতম গাম্ভীরের ক্রিকেটজীবনের অতীব গুরুত্বের ম্যাচ। কেকেআর অধিনায়ক হিসেবে এটা তার একশোতম ম্যাচ। আবেগের লাভাস্রোত ঘটবে না? আক্রোশ ছিটকে বেরোবে না? গৌতম গাম্ভীরও তো একটা মানুষেরই নাম!
সবচেয়ে বড় কথা, একশোর মুকুট আর একটু হলে কাঁটার মুকুটে পর্যবসিত হচ্ছিল। টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিল কেকেআর। গাম্ভীরও দেখাচ্ছিলেন টি-টোয়েন্টি ক্যাপ্টেন্সি কাকে বলে। বিরাট কোহালি যে বিরাট কোহালি, বোলিং চেঞ্জের দক্ষতায় তাকে পর্যন্ত চুপচাপ রেখে গেলেন। সতেরো ওভার পর্যন্ত একবারের জন্যও মনে হয়নি ম্যাচটা আরসিবির জেতার কোনও সম্ভাবনা আছে বলে। বিরাট হাফসেঞ্চুরি পেলেও প্রভাবে অর্ধেকও নন। ডি’ভিলিয়ার্স ব্যতিক্রমী ভাবে এ দিন ব্যর্থ। সতেরো ওভারে রান দেখাচ্ছে ১৩১। কিন্তু তখনও উমেশ যাদবের দ্বিতীয় স্পেলটা শুরু হয়নি। শুরু হল, এবং শেষ তিন ওভারে ৫৪ দিয়ে গেল কেকেআর বোলিং!
কে জানত, পাঠান-রাসেলের দাপটে ওটা ৩ ওভারে ৫৮ হয়ে বিরাট কোহালির দিকে পাল্টা ধেয়ে যাবে! আসলে যতটা ভাগ্যহীন কোহালিদের বিক্রমের বিরুদ্ধে একজন ক্যাপ্টেনকে দেখানো সম্ভব, একটা সময় পর্যন্ত গাম্ভীরকে তা দেখিয়েছে। ১৮৫ তাড়া করতে নেমে প্রথম ওভারে রবিন আউট। ক্রিস লিন তিনে নামলেন, এবং কয়েক ওভারের মধ্যে বোল্ড। কেকেআর ক্যাপ্টেন পর্যন্ত শ্রীনাথ অরবিন্দের একটা অসাধারণ ইয়র্কার ম্যানেজ না করতে পেরে আউট।
দশ ওভার যেতে না যেতে ৬৯-৪ টিম, চিকেন পক্স সারিয়ে টিমে ফেরা মণীশ পাণ্ডে ব্যর্থ, আস্কিং রেট বারো ছাড়িয়ে তেরো-সাড়ে তেরো, কেকেআরকে বাঁচাবে কে? রাসেল-পাঠান আছেন ঠিকই, কিন্তু তাদেরও সাধ্যের একটা তো সীমা-পরিসীমা আছে। ৬ ওভারে আরও ৮১ চাই— এ হয় নাকি? সবচেয়ে আতঙ্কের, শেন ওয়াটসন নামক এক বোলারের আরও দু’টো ওভার এখনও বাকি। যার বল ক্রিকেটের এই ফর্ম্যাটে খেলা কঠিন নয়, প্রবল কঠিন।
ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ভাল। আজকের পর, আরসিবিকে তাদের গুহায় এ ভাবে ধ্বংস করার নারকীয় দৃশ্য দেখার পর মাসল রাসেল আর পাঠান-পরাক্রমের বিচার কোনও দিন বোধহয় আর ক্রিকেটের ক্ষুদ্রবুদ্ধি দিয়ে করা উচিত নয়। স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে ছ’টা চার ও তিনটে ছয় মেরে ইউসুফ ২৯ বলে ৬০ নটআউট এবং কিছুই দেখাচ্ছে না।
ইউসুফের মারণলীলা আজ বুঝতে হলে গেইলকে দেখতে হবে। যিনি ম্যাচ শেষে ইউসুফের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। দেখতে হবে বিরাট কোহলিকে, যিনি সবার আগে ছুটে গিয়ে বাহবা দিয়ে এলেন সিনিয়র পাঠানকে। স্বাভাবিক। যে ইনিংসটা চিন্নাস্বামীতে সোমবার ইউসুফ খেলে গেলেন, তা গেইল বা বিরাট যে-ই হন, খেলতে পারলে গর্বিত বোধ করবেন।
কেকেআরের পাঠানকে নিয়ে একটা মজার গল্প চালু আছে যে, ইনি রোজ মোটেও খেলবেন না। কিন্তু যে দিন টিমের সবচেয়ে দরকার হবে, যে দিন আর কেউ বাঁচাতে পারবেন না, সে দিন বরোদা-বম্বার এমন রুদ্রমূর্তি ধরবেন যে, প্রতিপক্ষকে স্রেফ খড়কুটোর মতো উড়ে স্টেডিয়ামের বাইরে গিয়ে পড়তে হবে! দু’বছর আগে টিমকে প্লে অফে তোলার প্রয়োজনে ও রকম একটা বেরিয়েছিল। আজ, আবার বেরোল। একই প্রেক্ষাপটে। অধিনায়কের অত্যন্ত প্রয়োজনের সময়। সোমবার হেরে গেলে তো প্লে-অফ স্বপ্ন থেকে অনেক, অনেক দূরে চলে যেতেন ক্যাপ্টেন গাম্ভীর।
রাসেল(২৪ বলে ৩৯)-পাঠান মিলে ৪৪ বলে ৯৬ তুললেন। আরসিবির সেরা বোলিং অস্ত্র ওয়াটসনকে এমন বেধড়ক মারলেন যে, বহু দিন পাঠানকে মনে রাখবেন অস্ট্রেলীয়। তার ওভার থেকে ২৪ এল! ছ’ওভারে ৮১ থেকে প্রয়োজনের অঙ্ক নেমে দাঁড়াল ৩ ওভারে ২৩-এ! কাঁটার বদলে গাম্ভীর চিন্নাস্বামী ছাড়লেন বিরাটের বিরুদ্ধে মর্যাদার যুদ্ধ জিতে, একশোর মুকুটে পাঠান-রত্ন নিয়ে।
গৌতম গাম্ভীর আজ উত্তেজিত হবেন না তো আর কবে হবেন? চেয়ারে পদাঘাত আজ পড়বে না তো আর কবে পড়বে? জরিমানা হলে হবে, কিছু করার নেই। জেন্টেলম্যানস গেম হলেও ক্রিকেটটা তো সব সময় মাথা ঠান্ডা রেখে খেলা যায় না!
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.