নারীঘটিত নানা কেলেঙ্কারিতে চারদিক থেকে সমালোচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প আত্মরক্ষার উপায় হিসেবে ক্রমেই ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। ১৯ অক্টোবর (বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার, সকাল সাতটা) তিনি ও হিলারি ক্লিনটন সর্বশেষ বিতর্কে মিলিত হবেন। এর আগেই ট্রাম্প দাবি করে বসে আছেন, যৌন কেলেঙ্কারির যেসব অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, তার সবই মিথ্যা ও চক্রান্তের ফসল। এর পেছনে রয়েছেন হিলারি ক্লিনটন ও যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার তথ্যমাধ্যম। রিপাবলিকান নেতা ও স্পিকার পল রায়ান তাঁকে সমর্থন করে কোনো নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেবেন না—এই ঘোষণা দেওয়ার পর তাঁকে ও ওয়াশিংটনের সব পেশাদার রাজনীতিককে চক্রান্তকারীদের দলে অন্তর্ভুক্ত করেছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের সর্বশেষ ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হচ্ছে, শুধু হিলারি, তথ্যমাধ্যম ও রিপাবলিকান ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ নয়, ওয়াল স্ট্রিটের ধনকুবেররাও তাঁকে পরাজিত করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। তিনি বলেন, তাঁদের সবার উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হলো নিজেদের অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ দখলে রাখা। ‘এবারের নির্বাচনের সঙ্গে তাঁদের হাজার কোটি ডলারের স্বার্থ জড়িত।’ অভিযোগ তাঁর। ফ্লোরিডার পাম বিচে এক জনসভায় ট্রাম্প দাবি করেন, পেশাদার রাজনীতিক ও করপোরেট স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোয় তাঁকে বর্ণবাদী, নারীবিরোধী ও অনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ট্রাম্প তাঁর শত্রুদের যে তালিকা করেছেন, এর শীর্ষে রয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা। আমেরিকার এ দুই প্রধান পত্রিকায় ট্রাম্পের নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি উভয় পত্রিকার বিরুদ্ধে চটেছেন। চক্রান্তকারীদের এই তালিকায় তিনি এবার যুক্ত করেছেন ম্যাক্সিকান বিলিয়নিয়ার কার্লোস স্লিমকে। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ধনী এই ব্যবসায়ী নিউইয়র্ক টাইমস-এর অন্যতম শেয়ারহোল্ডার। ট্রাম্প অভিযোগ করেছেন, স্লিম বিভিন্ন সময়ে ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে চাঁদা দিয়েছেন। এখন তিনি ক্লিনটনের পক্ষে নির্বাচনের ফলকে প্রভাবিত করতে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকাকে ব্যবহার করছেন। স্লিম ও টাইমস উভয়েই ট্রাম্পের এই অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে। রিপাবলিকান পার্টির দায়িত্বশীল অংশ ট্রাম্পের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করলেও দলের অতি দক্ষিণপন্থী সদস্যরা এর ফলে দারুণভাবে উজ্জীবিত। এ কাজে তাঁকে মদদ দিচ্ছে ব্রেইটবার্ট নিউজ নামের ওয়েব পত্রিকা ও ফক্স নিউজ টিভি নেটওয়ার্ক। উভয় সংস্থাই গত আট বছর ওবামার শাসনের বৈধতা অস্বীকার করে এসেছে এবং আমেরিকার শ্বেতকায়দের বিরুদ্ধে তাঁর ও ডেমোক্র্যাটদের গোপন চক্রান্তের নানা মনগড়া তত্ত্ব প্রচার করে এসেছে। ব্রেইটবার্ট নিউজের প্রধান নির্বাহী স্টিভ বেনন এখন ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আমেরিকার অতি দক্ষিণপন্থী টক রেডিও, যারা বরাবর ক্লিনটন দম্পতি ও ওবামা প্রশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের জন্য পরিচিত, তারাও ট্রাম্পের ষড়যন্ত্রতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। স্বল্পশিক্ষিত ও কর্মজীবী শ্বেতকায় পুরুষদের মধ্যে এই টক রেডিও অসম্ভব জনপ্রিয়। ছয় বছর আগে রিপাবলিকান পার্টির ভেতরে যে কট্টর টি-পার্টি আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার পেছনে এই টক রেডিওর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
দক্ষিণপন্থী টক রেডিওর গুরু হিসেবে পরিচিত রাশ লিমবো ট্রাম্পকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ট্রাম্পের নারীঘটিত কেলেঙ্কারির পর তাঁর সমর্থনে যে কজন পরিচিত মুখ কথা বলেছেন, তিনি তাঁদের একজন। লিমবো যুক্তি দেখিয়েছেন, যদি কোনো যৌন সম্পর্ক হয়েই থাকে, তা অভিযোগকারী নারীদের সম্মতিতেই ঘটেছে। কারণ তাঁরা সে সময় এ নিয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি। ফক্স টিভির অন্যতম হোস্ট শন হ্যানিটিও একই যুক্তি ব্যবহার করে অভিযোগকারী নারীদের আক্রমণ করেছেন। হ্যানিটি দাবি করেছেন, নির্বাচনের তিন-চার সপ্তাহ আগে হঠাৎ এত নারী একযোগে অভিযোগ উত্থাপন করার ব্যাপারটি কাকতালীয় নয়, এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে, যার লক্ষ্য একটাই, ট্রাম্পকে ভোটে হারানো।
কেন্দ্রীয় নেতাদের সমর্থন হারালেও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে পুনর্নির্বাচন নিয়ে বিপদে আছেন, তাঁদের অনেকেই অবশ্য ট্রাম্পের পক্ষে রয়েছেন। পুরোপুরি রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত ‘রেড স্টেট’ নয় এমন অঙ্গরাজ্যের তৃণমূল পর্যায়ে ট্রাম্পের অতি উৎসাহী সমর্থকদের হাতে রাখার জন্য কংগ্রেস ও স্থানীয় নির্বাচনের রিপাবলিকান প্রার্থীরা নারীঘটিত কেলেঙ্কারি হিলারি শিবিরের ষড়যন্ত্র বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। যেমন ভার্জিনিয়ার লুডন কাউন্টির রিপাবলিকান চেয়ারম্যান উইল এস্ত্রাদা বলেছেন, সব ডাহা মিথ্যা কথা।
ট্রাম্পের জন্য সমস্যা হচ্ছে, যাঁরা এখন তাঁর পক্ষ সমর্থন করছেন, তাঁরা এমনিতেই ট্রাম্পের সঙ্গে রয়েছেন। এঁদের অধিকাংশই শ্বেতকায়, স্বল্পশিক্ষিত ও রক্ষণশীল। শুধু এঁদের ভোটে রক্ষণশীল রাজ্যসমূহে আইন পরিষদের নির্বাচনে জেতা সম্ভব, কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতা সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন দ নিরপেক্ষ ও সংখ্যালঘু গ্রুপগুলোর সমর্থন। নারীঘটিত ঘটনা যত প্রকাশিত হচ্ছে, এই ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন তত কমছে।
সে কথা মাথায় রেখে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তাঁর স্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছেন, ‘তোমার কিছু করার দরকার নেই। শুধু মুখ বুজে দেখ, ট্রাম্প কীভাবে নিজেকে নিজেই পুড়িয়ে মারে।’
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.