ক্রেডিট কার্ড দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে সিটি ব্যাংক। তথ্য গোপনের মাধ্যমে কয়েকজন ভিআইপি গ্রাহকের কাছ থেকেও অতিরিক্ত অর্থ নিয়েছে ব্যাংকটি। বাদ যাননি ক্ষমতাসীন দলের সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান এমপি, কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ অনেকে। সুদ কেটে নেয়া হচ্ছে ৬০ থেকে ৯৫ শতাংশ, যা অভাবনীয়। এ ছাড়া উচ্চসুদ ও গলাকাটা সার্ভিস চার্জের তথ্য গোপন করে ব্যাংকটি গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছে। গত চার বছরে বিভিন্ন ধাপে এসব প্রতারণা করা হয়। ভুক্তভোগী মহল সূত্রে এসব ভয়াবহ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, বিদেশে অনেক ক্রেডিট কার্ডের সুদ ধরা হয় না। তবে বাংলাদেশে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ১৮ থেকে ২৫ শতাংশ সুদ ধরা হয়। অর্থাৎ ৪৫ দিন পর্যন্ত ক্রেডিট বা ঋণ নেয়া টাকার ওপর কোনো সুদ দিতে হয় না। এরপর পরিশোধ করতে গেলে বার্ষিক ২৫ শতাংশ হারে সুদ কাটা হয়। কিন্তু সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে প্রায় ৬০ থেকে ৯৫ শতাংশ সুদ কেটে নেয়া হয় বলে দাবি করেন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী। বর্তমানে তিনি সংসদ সদস্য। তার মতে, এটা এক ধরনের প্রতারণা। গলাকাটা সার্ভিস চার্জ নিচ্ছে ব্যাংকটি। যুগান্তরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, একজন মন্ত্রী যখন সিটি ব্যাংকের কাছে জিম্মি তখন সাধারণ গ্রাহকের সঙ্গে কী আচরণ করে তা সহজে বোঝা যায়। তিনি আরও বলেন, সিটি ব্যাংক তথ্য গোপন করার মাধ্যমে কৌশলে গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তারা গ্রাহককে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেয় না। অর্থাৎ ক্রেডিট কার্ডে টাকা লেনদেনের পর ব্যালান্স কিংবা ঋণের পরিমাণ কত আছে তা জানানো হয় না। সব সময় কার্ড চালু রাখার সর্বনিু পরিমাণ জানিয়ে আসছে ব্যাংকটি। এতে গ্রাহক থাকছেন অন্ধকারে। গ্রাহক বুঝতে পারছেন না কী পরিমাণ অর্থ খরচ করলেন আর কী পরিমাণ অর্থ অ্যাকাউন্টে থাকল। এ ব্যাপারে ওই সংসদ সদস্য একটি লিখিত অভিযোগ সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর পাঠিয়েছেন। ২০১৬ সালের ৩০ জুন পাঠানো অভিযোগপত্রটি যুগান্তরের কাছে সংরক্ষিত আছে।
অভিযোগপত্রের তথ্য অনুযায়ী, সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে দেশে-বিদেশে কয়েক ধাপে প্রায় ১১ লাখ ৫৮ হাজার টাকা খরচ করেন এই সংসদ সদস্য। এতে বলা হয়, দেশে হোটেল ভাড়াসহ কেনাকাটায় ব্যাংকটি সুদ কেটেছে প্রায় ৯৫ শতাংশ। আর বিদেশে হোটেল ভাড়া ও কেনাকাটায় সুদ কেটেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। যৌক্তিক পরিমাণ অর্থ পরিশোধের পরও উচ্চসুদের কারণে বিপুল পরিমাণ অর্থ দাবি করে ব্যাংকটি। তিনি বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছি, ভুল করে মোটা অংকের অর্থ দাবি করা হয়েছে। কিন্তু জানতে চাইলে ব্যাংকের তরফ থেকে বলা হয়, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কোনো ভুল করেনি। জেনেশুনে তারা টাকা দাবি করেছে।’
অভিযোগপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে দেশে খরচ করা হয় ১ লাখ ৩ হাজার ৭৮৫ টাকা। বিপরীতে পরিশোধ করা হয় ১ লাখ ১৭ হাজার ৫৫৯ টাকা। কিন্তু ব্যাংক দাবি করে ১ লাখ ৯৬ হাজার ৭৫৫ টাকা। এখানে সুদের পরিমাণ প্রায় ৯৫ শতাংশ। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে খরচ করা হয় ১৩ হাজার ১৭৬ ডলার বা ১০ লাখ ৫৪ হাজার ৮০ টাকা। এ সময় পরিশোধ করা হয় ১৩ হাজার ৭২৩ ডলার বা ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪০ টাকা। কিন্তু ব্যাংক দাবি করে ২০ হাজার ১৭০ ডলার বা ১৬ লাখ ১৩ হাজার ৬০০ টাকা। এখানে সুদ কাটা হয় প্রায় ৬০ শতাংশ। এতে দেশে-বিদেশে উভয় লেনদেনে ব্যাংকের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত দাবি করা হয় ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৯৫৬ টাকা। এসব ঘটনা ঘটে গত চার বছরে।
জানতে চাইলে ‘দ্য সিটি ব্যাংক’-এর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন যুগান্তরকে বলেন, ‘অভিযোগকারী সাবেক মন্ত্রী গত পাঁচ বছর ধরে সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করছেন। কিন্তু উনার বেশ কয়েক মাসের বিল বকেয়া রয়েছে। সে কারণে তার কাছ থেকে অতিরিক্ত প্রায় ৬ লাখ টাকা নেয়া হয়েছে। তথ্য গোপনের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি আরও বলেন, ‘সিটি ব্যাংকে কোনো হিডেন চার্জ নেই। আরও যারা অভিযোগ করেছেন তাও ধোপে টিকবে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য যুগান্তরকে বলেন, ‘সিটি ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ডের বিষয়ে সময়মতো কোনো হালনাগাদ তথ্য জানানো হয় না। এভাবে তথ্য গোপন করে তারা গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে। শুধু আমি একা নই, শত শত গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করছে ব্যাংকটি।’
এদিকে ঘটনাটি জানার পর অনুসন্ধানে নামে যুগান্তর। এরপর আরও কয়েকটি ভয়াবহ প্রতারণার ঘটনা উঠে আসে। জানা যায়, সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড প্রতারণার শিকার হন চট্টগ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য। ব্যাংকের বিরুদ্ধে তার অভিযোগপত্রে দেখা যায়, ২০১৩ সালে ব্যবসায়িক কাজে লন্ডনে যান তিনি। যাতায়াতের জন্য একটি রেন্ট এ কার ভাড়া করেন। ভাড়া বাবদ খরচ হয় প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ পাউন্ড। এসব অর্থ সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। ১০ থেকে ১৫ দিন পর দেশে ফিরে পাউন্ডের সমপরিমাণ অর্থ ব্যাংককে পরিশোধ করেন তিনি। কিন্তু ব্যাংক আরও আড়াই লাখ টাকা দাবি করে। এত টাকা চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিভিন্ন সুদ ও সার্ভিস চার্জের কথা বলে একটি ব্যাখ্যা দেয় ব্যাংক, যা তার কাছে মোটেও সন্তোষজনক ছিল না। তবুও ব্যাংকের দাবি অনুযায়ী তিনি অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধ করেন।
ভুক্তভোগী একই ব্যবসায়ী গত বছর অক্টোবরে ব্যবসায়িক কাজে জার্মানি ও বেলজিয়াম যাওয়ার আগে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডে তিন হাজার ডলার সীমার বিপরীতে দেড় লাখ টাকা জমা করেন। কিন্তু বেলজিয়ামে গিয়ে সেখান থেকে কোনো অর্থ খরচ করতে পারেননি। দেশে ফিরে তিনি ব্যাংকটির কাছে এর কারণ জানতে চাইলে তাকে বলা হয়, কার্ডে থাকা দেড় লাখ টাকা ব্যাংক পাওনা ছিল। তাই কেটে নেয়া হয়েছে। নতুন করে অর্থ পরিশোধ না করলে কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন না। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের পরিচালক ইফতেখার মাহমুদ রাসেল যুগান্তরকে বলেন, সিটি ব্যাংক ক্রেডিট দিয়ে ডাকাতি শুরু করেছে। তথ্য গোপন করে বারবার প্রতারণা করছে ব্যাংকটি। এ ছাড়া সার্ভিস চার্জের নামে উচ্চসুদ কেটে নিচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকার একজন ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের রেকর্ড ভালো নয়। কয়েক বছর আগে তার কাছে একটি বিল পরিশোধের চিঠি আসে। সেখানে কোনো খরচ ছাড়াই প্রায় ৩৫ হাজার টাকার বিল পরিশোধের কথা বলা হয়। তিনি এই ভুতুড়ে বিলের কারণ জানতে চান। এরপর তথ্যানুসন্ধানে ধরা পড়ে, একটি ভুয়া বিল তার নামে ইস্যু করা হয়েছে। মূলত ওই বিল ছিল মিরপুরের এক নারী গ্রাহকের, যা তার নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। ঘটনার সত্যতা জানার পর তড়িঘড়ি করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ক্ষমা চায়। এরপর তিনি সিটি ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডটি বন্ধ করে দেন। ভুক্তভোগী এ ব্যবসায়ী বলেন, ব্যাংকটি আরও অনেকের সঙ্গে এভাবে ক্রেডিট কার্ড দিয়ে প্রতারণা করেছে।
পেশাগত কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গণমাধ্যমকর্মী যুগান্তরকে বলেন, ২০১৫ সালে হঠাৎ তার ক্রেডিট কার্ড বন্ধ করে দেয় সিটি ব্যাংক। কার্ডটি বন্ধ করার আগে কোনো নোটিশ দেয়নি। বলার পর দুঃখ প্রকাশ করে কার্ডটি আবার চালু করে দেয়। এভাবেও অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, সাধারণত ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী বা অন্য পেশাজীবী, যাদের ভালো আয় আছে এবং যারা বৈধ কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন), তারাই ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, একটি ক্রেডিট কার্ডের লিমিট বা টাকা খরচ করার সর্বোচ্চ সীমা পাঁচ লাখ টাকা। গ্রাহকের মাসিক আয়ের ভিত্তিতে এ সীমা নির্ধারিত হয়। ভিসা ও মাস্টার কার্ডের প্লাটিনামের বার্ষিক ফি সাড়ে ৪ হাজার টাকা, গোল্ড কার্ড আড়াই হাজার টাকা এবং ক্লাসিক বা সিলভার কার্ড দেড় হাজার টাকা। ক্রেডিট কার্ডে নগদ টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে আড়াই শতাংশ বা ১৫০ টাকা সার্ভিস চার্জ কাটা হয়। ডলারে অর্থ নিলে ৩ শতাংশ বা ৫ ডলার চার্জ লাগে। সময়মতো অর্থ পরিশোধ না করলে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা জরিমানা এবং ৫ থেকে ১৫ ডলার জরিমানা কাটে ব্যাংক। উল্লিখিত ফি একেক ব্যাংক একেকভাবে কাটে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.