২০০৭ সাল। আরব আমীরাত আদালত ছয় বাংলাদেশীর শিরচ্ছেদের রায় দিয়েছে। তাদের অপরাধ তারা এক পাকিস্তানিকে রান্নার বটি দিয়ে দুই টুকরো করে ফেলেছে। খবরটি শুনে অবাকই হলাম! একি করলো এরা! নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন রাখলাম- শেষমেষ বিদেশের মাটিতে বাঙালিরা অপরাধ জগতে জড়িয়ে গেলো তাহলে? আমার জীবনের প্রায় বারো বছর আমি আমিরাতে কাটিয়েছি। আমার প্রচুর বন্ধু-বান্ধব সেখানে। আমি থাকা অবস্থায় কোন বাংলাদেশীর শিরচ্ছেদ করা হয়েছে বলে শুনিনি। মধ্যপ্রাচে্য যত অপরাধ হতো তার ৯৯ ভাগ অপরাধীরা ছিল পাকিস্তানি, সুদানি এবং সোমালিয়রা। এখনও চুরি হলে প্রথম নাম আসে সুদানি এবং সোমালিয়দের। ধর্ষন এবং ড্রাগসএর ঘটনা ঘটলে প্রথম নাম আসে পাকিস্তানিদের। বুঝা যায় জন্ম থেকে এই জাতিগুলি অপরাধী। বাঙালিরা আরবিদের কাছে ‘মিসকিন’ জাতি হলেও খুবই বিশ্বস্ত। বাঙালিরা দেশে যাই করুক বিদেশে সৎ জীবন যাপন করে। বাঙালিরা চুরি করে না, ড্রাগস-এর ব্যবসা করে না, ধর্ষণ, খুন তথা কোন ধরনের অপরাধে জড়িত হয় না। সময়ের আগে বাঙালিরা কর্মস্থলে পৌঁছায়। নিয়োগকর্তাদের মধে্য বাঙালিরা হচ্ছে প্রথম পছন্দ। অর্থাৎ নাম্বার ওয়ান।
ঘটনার পূর্বাপর: আরবিদের পুরনো একটি বড় বাড়িতে বেশ ক’জন ব্যাচেলর বাঙালি, পাকিস্তানি এবং ভারতীয় কয়েকটি রুম ভাগাভাগি করে বসবাস করে। পেশায় এরা সবাই সাধারণ শ্রমিক। তারা বিভিন্ন কন্ট্রাকটারের অধীনে খুব অল্প বেতনে কাজ করে। ছোট্ট একটা রুমে গাদাগাদি করে থাকে। যেখানে থাকার কথা একজন সেখানে থাকে দশজন। দেশে থাকা পরিবার পরিজনের স্বার্থে এ কষ্টের জীবন তারা এভাবেই মেনে নিয়েছে।
এক শুক্রবার ছুটির দিন বিকেলে দুই রুমমেট রান্নার জন্য তরকারি কুটছিল। রুমের ভেতর ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছে বাংলা গান। এমন সময় ঐখানে এক পাকিস্তানির আগমন ঘটে। একথা, সেকথা বলার পর এক পর্যায়ে সে কটাক্ষ সূরে বলে- তোমাদের খাওয়া দাওয়া, চলা-ফেরা সব ইণ্ডিয়ানদের মতো। একজন উত্তর দেয়- ‘ইণ্ডিয়ানদের মতো হতে যাবে কেন? আমরা আমাদের মতো করে খাই, আমরা আমাদের ষ্টাইলে চলি। মুর্খের মতো কথা বলো কেন?’ পাকিস্তানিটি তখন বলে- ‘তোমাদের জন্মটা কি আমার অজানা? ইণ্ডিয়াকে পাকিস্তানিরা …. করে গাভিন করেছিল আর তারপরে তোমাদের ঐ তথাকথিত সোনার বাংলার জন্ম’। এক বাঙালি তখন তাকে মুখ সামলে কথা বলার জন্য অনুরোধ করে। অন্য বাঙালিটি তাকে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য বলে। পাকিস্তানিটি তখন আরও গলা উঁচিয়ে তাদের উদ্দেশ্য করে বলে- ‘৭১ সালে পাকিস্তানীরা ৯৯% বাঙালি নারীকে গর্ভবতী করে এসেছিল; এরপর থেকে বাঙালি একটা কালো, একটা সাদা, যেমনটি তোমরা দুইজন দুই রকম..,।’ এক বাঙালি আর ধৈর্য রাখতে পারে না। হাতের কাছে থাকা রান্নার বটি দিয়ে এক কোপে পাকিস্তানিটিকে দুই টুকরা করে ফেলে। অর্থাৎ শরীর থেকে মাথা আলাদা হয়ে যায়। পলকের মধ্যে ঘটে যায় ঘটনা। ছুটে আসে আশে পাশের মানুষ। আসে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে হাতকড়া লাগিয়ে ঘরের মধ্যে যে ক’জন ছিল সবাইকে ধরে নিয়ে যায়।
ঘটনার অতঃপর: স্থানীয় মিডিয়ায় ফলাও করে চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি প্রকাশ পায়। মুখে মুখেও খবরটি পৌঁছে যায় এক শহর থেকে অন্য শহরে। মামলা ওঠে আদালতে। বাঙালিটি একা খুন করেছে বলে স্বীকারোক্তি দিলেও তাকে সহযোগিতা করার অপরাধে বাকিদেরও দোষী সাব্যস্থ করে আদালত। আমিরাতের নিয়ম অনুযায়ী হত্যার সাজা হত্যা অর্থাৎ শিরচ্ছেদ। তবে নিহতের নিকটাত্মীয় (স্ত্রী, সন্তান, মা, বাবা) যদি ক্ষমা করে দেয় তাহলে সাজা মওকুফ হতে পারে। অথবা যদি আদালত কর্তৃক নির্ধারিত নগদ অর্থদন্ড (Blood Money) পরিশোধ করা যায় তবে শিরচ্ছেদ রহিত হতে পারে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করা হলো নিহতের পরিবারের সাথে, কিন্তু লাভ হলো না। তারা কেবল আদালত কর্তৃক নির্ধারিত অর্থদন্ডের পক্ষে অবস্থান নিলো।
দন্ডপ্রাপ্তদের বাড়ি চট্টগ্রামের কোন এক অঁজপাড়াগাঁয়ে। বলতে গেলে সবাই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। কেউ কেউ অতি দরিদ্র পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এত টাকা তারা পাবে কোথায়? এদিকে প্রকৃত ঘটনা জানাজানি হওয়ায় ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে থাকে আমিরাত প্রবাসী বাঙালিরা। আদালতের রায়ে তাদের রক্ত টগবগ করে ওঠে। আলাপ আলোচনায়, টেলিফোনে-সাক্ষাতে একই কথা- ‘খুন করেছে বেশ করেছে। উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে। তার জায়গায় আমরা হলেও একই কাজ করতাম।’ আবেগপ্রবণ বাঙালির অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে। হত্যাকারি যুবক যে একজন দেশপ্রেমিক তাতে কারো কোন সন্দেহ নাই। দেশের অপমান সহ্য করতে পারেনি বলেই সে পাকিস্তানিকে হত্যা করেছে। একজন বীর হিসেবে যুবকটি সকল বাংলাদেশির হৃদয়ে স্থান করে নিলো। এরপর পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যেতে থাকে।
জনমত তৈরি হতে বেশি দিন লাগলো না। শুরু হলো প্রচারণা এবং অর্থ সংগ্রহ। দলমত নির্বিশেষে সকল বাঙালি এক কাতারে। এ যুবকদের বাঁচাতেই হবে। জাতির ইজ্জতের প্রশ্ন। অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালিরা আজ পর্যন্ত সম্মিলতভাবে যত কাজে হাত দিয়েছে সবগুলোতে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে এবং এক্ষেত্রেও ব্যর্থ হলো না। চট্টগ্রামের চেম্বার এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও অর্থ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এলেন।
সহযোগিতার জন্য দূতাবাসের ওপরও চাপ সৃষ্টি করা হলো। খবর চলে গেলো পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় হয়ে সরকারের উচ্চমহলে। ঘটনার বিস্তারিত শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবুধাবী পাঠালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমণিকে। কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনা হলো। তারা জানালো, যদি নির্দিষ্ট তারিখের আগে উল্লিখিত অর্থ পরিশোধ করা হয় তাহলে দন্ডপ্রাপ্তরা শিরচ্ছেদ থেকে মুক্তি পেতে পারে। দীপুমণি আলোচনার সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীকে জানালেন। সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্ত ৬ জন বাংলাদেশীকে বাঁচাতে ১১১,৬২৭ ইউরো (প্রায় ৯০ লক্ষ টাকা) প্রদান করার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিলেন।
অতঃপর আবুধাবীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নির্দিষ্ট তারিখের একদিন আগে উল্লিখিত অর্থ পরিশোধ করলে উক্ত বাংলাদেশী তরুণরা শিরোচ্ছেদ-এর আদেশ থেকে রেহাই পায়। অবশেষে ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে তারা বীরের মর্যাদায় দেশের উদ্দেশে রওয়ানা হয়। বিভিন্ন শহর থেকে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি দুবাই বিমানবন্দরে ছুটে আসে তাদেরকে একনজর দেখার জন্য। স্থানীয়ভাবে যে অর্থ সংগ্রহ হয়েছিলো তা ঐ ৬ তরুনদের প্রবাসীদের পক্ষ থেকে উপঢৌকন হিসেবে প্রদান করা হয়।
সর্বোপর: এ ঘটনায় পুরো আরব ভূখন্ডে বিরাট চাঞ্চলে্যর সৃষ্টি হয়। বাঙালিদের এখন চরম ভয় পায় পাকিস্তানিরা। এখন কোন জায়গায় বাঙালিদের পাশে পাকিস্তানিরা বাসাবাড়ি ভাড়া নিতে সাহস পায় না। কর্মক্ষেত্রে বাঙালিদের সাথে কথাবার্তা বলতে এখন তারা হিসাব করে কথা বলে। অন্যদিকে এ ঘটনায় অন্যান্য ভাষাভাষীদের মাঝে বাঙালিরা একটি দেশপ্রেমিক জাতি হিসেবে সম্মান লাভ করে।
পুনশ্চঃ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে খবরটি জোরালোভাবে প্রকাশ এবং প্রচার লাভ করে। পত্রিকায় আমার লেখাটি পড়ে এক পাঠকবন্ধু রেডিও ফ্রান্স ইন্টারন্যাশানাল (আরএফআই)-এর একটি লিংক পাঠিয়েছেন।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.