কেরানীগঞ্জে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নির্মাণে ৩৬ ধরনের ত্রুটি চিহ্নিত হয়েছে। রান্নাঘর ও বাথরুম নির্মাণে বড় ধরনের ত্রুটি শনাক্ত হয়েছে। বন্দির তুলনায় সাক্ষাৎকক্ষ ছোট। অপেক্ষাগার রাখা হয়নি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানদের স্কুলের জন্য হয়নি নকশা প্রণয়ন। পুকুর খনন হয়নি। নির্মাণ করা হয়নি সেন্টার টাওয়ার ও মসজিদ। এসব ত্রুটি দূর করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তালিকা তৈরির পর নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে সমস্যাগুলো দূর করবেন এই কর্মকর্তা। নবনির্মিত এ কারাগারের নির্মাণ অগ্রগতি নিয়ে এক সভায় উল্লেখিত সিদ্ধান্ত হয় বলে কারা অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগার দেশের একটি বড় স্থাপনা। ইতিমধ্যে কারাগারটি প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। এর আগে কয়েকবার কারাগারটি পরিদর্শন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবারই কিছু নির্মাণ ত্রুটি তার চোখে পড়েছে। মনে হয়েছে, এখানকার প্রকল্প পরিচালক, প্রকৌশলী ও ঠিকাদার প্রায় সবাই নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন। রাষ্ট্রীয় এ স্থাপনাটি যত্নসহকারে নির্মাণ করা হয়নি। ছোটখাটো অনেক নির্মাণ ত্রুটি রয়েছে।’
এ নিয়ে কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি উল্লেখ করে মোজাম্মেল হক খান বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালককে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে (কারা) এসব ত্রুটি দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তিনি সেখানে সরেজমিন গিয়ে ত্রুটি-বিচ্যুতির তালিকা করবেন। সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তা পুনঃনির্মাণ করে দেবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া। কিছু নতুন বিষয় সংযোজন করারও সিদ্ধান্ত রয়েছে, যা পরবর্তীকালে নকশা সংশোধনের মাধ্যমে করা হবে।’
গত ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেরানীগঞ্জের এ কারাগার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন। এর মাধ্যমে আড়াইশ’ বছরের পুরনো কারাগার ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোড থেকে কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে কেরানীগঞ্জে নবনির্মিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারটির নির্মাণে নানা ত্রুটি ও অনিয়ম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন কারা অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাগুলোর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে ২৯ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় তিনি এ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে স্থানান্তর ও এর সামগ্রিক বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রকল্প পরিচালক বলেন, একটি ব্যারাক ছাড়া সব ভৌত নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। নির্মাণ কাজের যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, সেটাও সংশোধন করা হয়েছে। এ সময় আইজি প্রিজন্স সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন কারাগার নির্মাণের নানা অনিয়ম ও ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কারাগারের জন্য গণপূর্ত অধিদফতরের উড ওয়ার্কশপ থেকে আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশের গুণগত মান ও পরিমাপ সঠিক হয়নি। নির্মাণ উপকরণও নিুমানের। তখন বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে বলে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু পরে আর তা খতিয়ে দেখতে কোনো কমিটি গঠন করা হয়নি।
সর্বশেষ ১ আগস্ট কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীনের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ৩৬টি নির্মাণ ত্রুটির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- রান্নাঘরের এডজাস্ট ফ্যান লাগানো এবং ভাতের মাড় ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা। বন্দিদের গোসলের জন্য ওয়ার্ডের পাশে অতিরিক্ত চৌবাচ্চা নির্মাণ ও তাতে পানি সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত পাইপ সংযোজন করা। বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জন্য কক্ষ অপ্রতুল, এ কারণে অতিরিক্ত কক্ষ নির্মাণ করা। সাক্ষাৎপ্রার্থীদের জন্য অপেক্ষাগার শেড নির্মাণ করা। কারাগারের ভেতরে পর্যাপ্ত ডাস্টবিন নেই। ফলে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা হচ্ছে। এছাড়া বন্দিদের ওয়ার্ডের সামনে নিচতলায় টয়লেট নির্মাণ জরুরি। পাশাপাশি কারাগারের উৎপাদন বিভাগকে আরও সম্প্রসারণ করতে হবে, বর্তমানে যা রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুব ছোট। এছাড়া গাড়ির জন্য অতিরিক্ত গ্যারেজ নির্মাণ, ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড নির্মাণ, কারাগারের ভেতরে বড় গাড়ি প্রবেশের ব্যবস্থা করা, পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করা, ক্যাফেটেরিয়া নির্মাণের বিষয় গুরুত্ব দেয়া হয়। এছাড়া কারারক্ষী ব্যারাকে এমআই ইউনিটে স্যালুন স্থাপন, পরিদর্শন বাংলো নির্মাণ, করারক্ষীদের জন্য আলাদা ব্যারাক নির্মাণ, আবাসিক ভবনের টয়লেটের পানি নিষ্কাশন ও অন্যান্য সমস্যা দূর করতে বলা হয়েছে।
কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়া ইউনিয়নের রাজেন্দ্রপুরে ১৯৪ দশমিক ৪১ একর জমির ওপর তৈরি হয়েছে নতুন এই কারাগার। বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে সীমানা প্রাচীর। এই কারাগারের ধারণ ক্ষমতা ৪ হাজার ৫৯০ জন। তবে ৭-৮ হাজার বন্দি থাকতে পারবে। ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের জন্য ৬০টি বিশেষ কক্ষ থাকছে। এর পাশাপাশি নারী, কিশোর অপরাধে অভিযুক্ত কিশোর বন্দি ও মানসিক ভারসাম্যহীন বন্দিদের জন্য রয়েছে বিশেষ সেল। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিনোদনে অফিসার্স ক্লাব, কর্মচারীদের জন্য স্টাফ ক্লাব, স্কুল, লাইব্রেরি, মসজিদ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ সভার জন্য অডিটোরিয়াম নির্মাণের কথা রয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.