মৃত্যুর জন্য আবেদন! তাও আবার পরিবারের সদস্যদের জন্য!
এমনটাই করলেন নিরুপায় এক পিতা।
প্রাণঘাতি রোগে আক্রান্ত ২ সন্তান ছাড়াও স্ত্রী ও নাতির মৃত্যুর অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করলেন মেহেরপুর শহরের বেড়পাড়ার তোফাজ্জেল হোসেন। বুধবার বিকেলে এ আবেদনটি করেন তিনি।
‘ডুকিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি’আক্রান্ত ব্যক্তির নিশ্চিত পরিণতি পঙ্গুত্ব থেকে মৃত্যু। এমনই রোগে আক্রান্ত মেহেরপুর শহরের ওই পরিবারের সদস্যরা।সহায়-সম্বল বিক্রি করে তাদের চিকিৎসা করানো হলেও রোগমুক্তি ঘটেনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তোফাজ্জল হোসেন একসময় পান-বিড়ি বিক্রয় করতেন। তাঁর স্ত্রী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। দু’ছেলে বিছানাগত। মেয়ের একমাত্র ছেলেও একই রোগে আক্রান্ত। বড় ছেলে আবদুস সবুর (২৪), ছোট ছেলে রায়হান হোসেন ও নাতি সৌরভ হোসেন (৮) ‘ডুফিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি’ রোগে আক্রান্ত। দেশে ও ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে দোকানসহ সহায়-সম্বল সব বিক্রি করেছেন তিনি। এখন চিকিৎসাতো দুরে থাকা তাদের মুখে দু’বেলা দু’মুখো ভাত তুলে দিতে পারছেন না।
জানা গেছে, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াবস্থায় আবদুস সবুরের শরীরে রোগটি দেখা দেয়। প্রথমে পায়ের শক্তি কমতে থাকে। আস্তে আস্তে শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-পত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে আসতে থাকে। বর্তমানে বিছানাগত সবুর। একেবারেই পঙ্গু দশা। ছোট ছেলে রায়হান হোসেনরও একই অবস্থা। সে পায়ে কিছুটা বল পেলেও তেমন হাঁটাচলা করতে পারে না। একমাত্র মেয়ের ছেলে সৌরভ হোসেনও বর্তমানে একই রোগে আক্রান্ত।
মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হাবিব ইফতেখার আহমাদ জানান, সাধারণত মায়েদের কাছ থেকে ছেলেসন্তানরা এ রোগে আক্রান্ত হয়, মেয়ে সন্তান না। তবে ওই মেয়ের গর্ভের পুত্র সন্তানও একই রোগে আক্রান্ত হতে পারে, যা এই পরিবারে ঘটেছে। ক্রোমোজমগত কারণে ছেলেদের এ রোগ হয়।
ছেলেদের ১৮-১৯ বছরের মধ্যে এই রোগ দেখা দিতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথম ভর দিয়ে হাঁটতে পারবে না। ওপরে উঠতে পারে না। আস্তে আস্তে পঙ্গু হয়ে যাবে। এক পর্যায়ে বিছানাগত এবং ৩০ বছরের মধ্যে মারা যেতে পারে।
এদিকে, দুই ছেলের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের পাশাপাশি ভারতের কয়েকটি হাসপাতালে হেঁটেছেন তোফাজ্জেল হোসেন।
ভারতের কেয়ার হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ গৌরাঙ্গ মণ্ডল, তপন কুমার বিশ্বাস, ভারতের কোঠারি মেডিক্যাল সেন্টারের শিশু বিশেষজ্ঞ ড. স্বপন মুখার্জি সবুরের মল-মূত্র, রক্ত, কফ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন ‘ডুকিনি মাসকুলার ডিসট্রোফি’ ডিজিজ হয়েছে। দেশের কয়েকজন চিকিৎসকও একই কথা বলেছেন।
সন্তানদের চিকিৎসার জন্য তোফাজ্জেল হোসেন দেশের বিভিন্ন ধর্নাঢ্য ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দূতাবাসেও ছুটে গেছেন। ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাস সহযোগিতা দিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে এ রোগের ওষুধ কী জানতে চায়। শত শত চিকিৎসক ইন্টারনেটে জানিয়েছেন, এখনো এই রোগের কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। ফলে তোফাজ্জেল হতাশ হয়ে পড়েন।
ক্যান্সারের চেয়েও এ রোগ ভয়াবহ উল্লেখ করে কয়েকজন শিশু বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আক্রান্তের শরীরে সব অংশের মাংসপেশী আস্তে আস্তে জমাট বেঁধে যাবে। চলাফেরা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে যাবে। তাই চিকিৎসায় সুফল মিলবে না। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে যন্ত্রণাও।
ভারতের নামকরা এক হোমিও চিকিৎসক তোফাজ্জেল হোসেনকে বলেছেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসায় এ রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু অর্থের অভাবে সেখানে তিনি সন্তানদের নিয়ে যেতে পারছে না। শেষ চেষ্টা হিসেবে এখন সেখানে যেতে চান। তাই সন্তানদের ভরণ-পোষণ ও চিকিৎসার জন্য সহৃদয় ব্যক্তিদের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছেন তোফাজ্জেল হোসেন।’
তোফাজ্জেল হোসেনের চোখে এখন শুধুই জল। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তিনি চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছেন। কিন্তু উপায় মিলছে না। উপরন্ত চোখের সামনে নিভে যেতে বসছে দুই সন্তান ও নাতির জীবন প্রদীপ। একজন পিতার পক্ষে সন্তানের মৃত্যু যন্ত্রণা কতটা দুঃসহ, তা শুধুই জানেন এমন বাস্তবতার শিকার মানুষ। পৃথিবীতে সবচে’ কঠিন বিষয় হচ্ছে ‘পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ’।
প্রতিদিন বিশ্বের নানা প্রান্তে সহৃদয় মানুষের সহযোগিতায় অনেক দৃষ্টান্তমূলক ঘটনার জন্ম হচ্ছে। তবে এই অসহায় পরিবার কেন পাবে না সহযোগিতা? এ প্রশ্ন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যদের। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সন্তানদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করতে পারাটাই এখন তোফাজ্জেল হোসেনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
তোফাজ্জেল হোসেনের আবেদনের প্রেক্ষিতে শুক্রবার দুপুরে তার বাড়ি পরিদর্শন করেছেন মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ। তিনি পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তাদের কিছু ব্যয় বহনের ঘোষণা দেন। জেলা প্রশাসক বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। আবেদনটি পড়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই পরিবারের জন্য আমি সাধ্যমত চেষ্টা করবো। সমাজের সবাইকে অসহায় পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.