কোটি কোটি গ্রাহকের ই-মেইল তথ্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছিল ইয়াহু। প্রতিষ্ঠানটির সাবেক কয়েকজন কর্মী বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এই তথ্য জানিয়েছেন। এ নিয়ে রয়টার্সের বিশেষ এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী সকল গ্রাহকের ই- মেইলে সুনির্দিষ্ট তথ্য খুঁজে বের করতে গত বছর বিশেষ একটি সফটওয়্যার তৈরি করেছিল ইয়াহু। ইন্টারনেট সেবাদানকারী এ প্রতিষ্ঠানটি মার্কিন সরকারের ‘ক্লাসিফায়েড’ চাহিদা পূরণ করতে তৈরি করেছিল সফটওয়্যারটি। এই সফটওয়্যার দিয়ে কোটি কোটি ইয়াহু মেইল একাউন্টে আগত ই-মেইল স্ক্যান করে প্রতিষ্ঠানটি। ইয়াহুকে এমন নির্দেশনা দিয়ে থাকতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা (এনএসএ) বা গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো গোয়েন্দা সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অনুরোধের ভিত্তিতে ইতিমধ্যেই জমে থাকা ই-মেইল বা স্বল্পসংখ্যক ই-মেইল একাউন্টের তথ্য সার্বক্ষণিক নজরদারির বদলে সব ই-মেইল একাউন্টে প্রতিনিয়ত আসতে থাকা ই-মেইল স্ক্যান করার ঘটনা এটাই প্রথম। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ইয়াহু মেইলে আগত সব ই-মেইলে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্যটি খুঁজেছিলেন তা জানা যায়নি। শুধু জানা গেছে, তারা ইয়াহুকে কেবল কয়েকটি অক্ষরের একটি গুচ্ছ খুঁজতে বলেছিলেন। এটা হতে পারে ই-মেইলে বা ই-মেইলে সংযুক্ত ফাইলে (অ্যাটাচমেন্ট) সুনির্দিষ্ট কোনো শব্দ বা শব্দগুচ্ছের সন্ধান। ইয়াহু ঠিক কোন্ তথ্যগুলো গোয়েন্দাদের কাছে হস্তান্তর করেছে তা জানা সম্ভব হয়নি। ইয়াহু ছাড়া অন্য আরো কোনো ই-মেইল সেবাদানকারী কোম্পানিকেও এমন অনুরোধ করা হয়েছিল কিনা, সেটাও জানা যায়নি। এ খবর দিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। খবরে বলা হয়, রয়টার্সকে এসব তথ্য জানিয়েছেন বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ইয়াহু’র সাবেক তিন কর্মী এবং চতুর্থ আরেক ব্যক্তি। তারা কেউই নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি। ইয়াহুর সাবেক কর্মীদের মধ্যে দুইজন জানিয়েছেন, ইয়াহু’র প্রধান নির্বাহী মারিসা মেয়ার গোয়েন্দা সংস্থার এমন নির্দেশনা অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তার এই সিদ্ধান্তে ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তা ক্ষুব্ধও হয়েছিলেন। তার জের ধরেই গত বছরের জুন মাসে ইয়াহুর তৎকালীন প্রধান তথ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তা অ্যালেক্স স্ট্যামোস ইয়াহু ছেড়ে দেন। তিনি বর্তমানে ফেসবুকের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধানের পদে রয়েছেন। ই-মেইলের তথ্য গোয়েন্দা সংস্থাদের জন্য স্ক্যান করা বা গ্রাহকদের ই-মেইলের তথ্য তাদের হাতে দিয়ে দেয়া বিষয়ে রয়টার্স জানতে চাইলে কোম্পানিটি সংক্ষিপ্ত একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ইয়াহু আইন মেনে চলা একটি কোম্পানি এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রের আইন মেনে চলে।’ বাড়তি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। রয়টার্সের পক্ষ থেকে ফেসবুকের একজন মুখপাত্রের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার নিতে চাওয়া হলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানান স্ট্যামোসও। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে এনএসএ যোগাযোগ করতে বলে ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের কার্যালয়ে। সেখান থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত তিনজন জানান, ইয়াহু মেইলের কাছে তথ্যের এসব অনুরোধ এসেছিল ক্লাসিফায়েড প্রজ্ঞাপন হিসেবে, কোম্পানির লিগ্যাল টিমের কাছে। মার্কিন টেলিকম ও ইন্টারনেট কোম্পানিগুলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ তথ্য দিয়ে থাকে বলে জানা যায়। তবে কয়েকজন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও প্রাইভেট সারভাইল্যান্স বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিনিয়তই কোনো কোম্পানির সব গ্রাহকের তথ্য রিয়েল-টাইমে পাওয়ার মতো চাহিদা তারা আগে দেখেননি। এই চাহিদা এতই বিশাল ছিল যে, সেই তথ্য সংগ্রহের জন্য নতুন কম্পিউটার প্রোগ্রাম বানাতে হয়েছে ইয়াহুকে। এ বছরে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন আইনজীবী আলবার্ট জিদারি। এর আগে ২০ বছর তিনি ফোন ও ইন্টারনেট কোম্পানির পক্ষে সারভাইল্যান্স ইস্যুতে আইনি লড়াই চালিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘একটি ‘সিলেক্টরে’র জন্য রিয়েলটাইমে আড়িপাতার ঘটনা আমি কখনই দেখিনি। এটা কোম্পানির জন্যও সত্যিকার অর্থেই খুব কঠিন কাজ।’ সুনির্দিষ্ট কিছু খোঁজার জন্য যে শব্দ বা শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করা হয় তাকে ‘সিলেক্টর’ বলা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনএসএ বা এফবিআই অন্য ইন্টারনেট কোম্পানির কাছেও একই ধরনের অনুরোধ পাঠিয়ে থাকতে পারে। আবার এনএসএ সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নজরদারির জন্য এফবিআইয়ের সহায়তা নিয়ে তথ্যের অনুরোধগুলো পাঠিয়ে থাকে। ফলে ঠিক কোন্ সংস্থাটি এসব তথ্য চেয়েছে, তা জানাটা কঠিন। ই-মেইল সেবা প্রদানকারী বৃহৎ অন্য দুই প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেটের গুগল এবং মাইক্রোসফট মঙ্গলবার জানিয়েছে, তারা এ ধরনের কোনো ই-মেইল স্ক্যানিংয়ের কাজ করেনি। গুগলের একজন মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা কখনই এ ধরনের অনুরোধ পাইনি। তবে আমরা যদি এ ধরনের অনুরোধ পেতাম, আমাদের জবাব হতো ‘কোনোভাবেই নয়’।’ মাইক্রোসফটের একজন মুখপাত্র বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইয়াহু সম্পর্কে যে ধরনের খবর এসেছে, গোপনে ই- মেইলের আসা-যাওয়ার তথ্যের তেমন ধরনের স্ক্যানিংয়ে আমরা কখনই সংশ্লিষ্ট ছিলাম না।’ এ ধরনের অনুরোধ কখনও মাইক্রোসফট পেয়েছিল কি না, তা জানায়নি কোম্পানিটি। ফরেন ইন্টেলিজেন্স সারভাইল্যান্স অ্যাক্টের (ফিসা) ২০০৮ সালের সংশোধনীসহ মার্কিন আইন অনুযায়ী, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মার্কিন ফোন ও ইন্টারনেট কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের তথ্য দাবি করতে পারে। সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধসহ নানা কারণে বিদেশি গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা এ ধরনের অনুরোধ পাঠাতে পারে। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে নজরদারি কোন্ পর্যায়ে গিয়েছে এবং এমন অনেক নজরদারির কর্মসূচিই সরকারের সহায়তায় পরিচালিত হয়েছে- এডওয়ার্ড স্নোডেন ও অন্যদের ফাঁস করা নথি থেকে এমনটি জানা গেছে। গোপন ট্রাইব্যুনাল ফরেন ইন্টেলিজেন্স সারভাইল্যান্স কোর্টের ইয়াহুসহ আরো কয়েকটি কোম্পানি ক্লাসিফায়েড নজরদারি নিয়ে চ্যালেঞ্জও করেছে। ফিসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইয়াহুর কাছে গত বছর তথ্য চেয়ে যে অনুরোধ এসেছিল তা ইয়াহু কমপক্ষে দুইটি জায়গা থেকে চ্যালেঞ্জ করতে পারতো- নির্দেশনার বিস্তৃতি ও সব গ্রাহকের ই- মেইলের তথ্য অনুসন্ধানে নতুন প্রোগ্রাম তৈরি। এ বছরের শুরুর দিকে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল অ্যাপলের ক্ষেত্রে। তারা এফবিআইকে একটি আইফোনের তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। এ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত অ্যাপল ওই ফোনটি আনলক না করে দিলে এফবিআই থার্ড পার্টির মাধ্যমে ওই ফোনটি আনলক করতে বাধ্য হয়। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের একজন অ্যাটর্নি প্যাট্রিক টুমি এক বিবৃতিতে বলেন, এ ধরনের নজরদারির আদেশকে ইয়াহু চ্যালেঞ্জ করেনি, এটা খুব হতাশাজনক। কারণ এমন নজরদারির বিরুদ্ধে গ্রাহকরা প্রযুক্তি কোম্পানির ওপরই নির্ভর করে থাকে। তবে ফিসা অনেক বিশেষজ্ঞ ইয়াহুর গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশ মেনে চলার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। বলেছেন, এ ধরনের তথ্য চাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই এবং ফোন কোম্পানির কাছ থেকে যেমন বিপুল পরিমাণ তথ্য (বাল্ক) চাওয়া হয় তা ওয়েব কোম্পানির ই-মেইলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে একই যুক্তিতে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ডাটা এনক্রিপশন যত উন্নত হবে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এ ধরনের অনুরোধ তত বাড়বে। ইয়াহু’র কাছে গত বছরে সব ই-মেইল একাউন্টে নজরদারির নির্দেশনা এলে তার বিরুদ্ধে লড়াই করার বদলে তা মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন মেয়ার ও অন্যান্য নির্বাহীরা। বিষয়টি সম্পর্কে অবগত একজন বলেন, এর একটি কারণ হতে পারে- তারা ধারণা করেছিলেন যে লড়াই করলে তারা হেরে যাবেন। ২০০৭ সালে ফিসা আইনে সুনির্দিষ্ট একটি ই-মেইল একাউন্টে নজরদারির নির্দেশের বিরুদ্ধে আদালত পর্যন্ত গিয়েছিল ইয়াহু। ওই মামলা ধামাচাপা পড়ে গেলেও প্রকাশিত আংশিক একটি মন্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, ইয়াহুর ওই চ্যালেঞ্জ সফল ছিল না। ওই সূত্রটি বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে নজরদারির এমন নির্দেশনার বিরুদ্ধে না যাওয়ার কারণে ইয়াহুর অনেক কর্মী অসন্তুষ্টও। তাছাড়া এই নজরদারির প্রক্রিয়ায় মারিসা মেয়ার ও জেনারেল কাউন্সেল রন বেল কোম্পানির সিকিউরিটি টিমের বদলে ই-মেইল প্রকৌশল বিভাগকে কাজে লাগানোয় অনেকেই হতাশ ছিল। সব ই-মেইল একাউন্টে নজরদারির জন্য নতুন সফটওয়্যার ইনস্টল করার এক সপ্তাহের মধ্যেই তার সন্ধান পেয়ে যায় সিকিউরিটি টিম। সেটা ২০১৫ সালের মে মাসের কথা। সিকিউরিটি টিম প্রথমে ধারণা করেছিল, হ্যাকাররা তাদের সিস্টেমে ঢুকে পড়েছে। স্ট্যামোস যখন জানতে পারেন যে মেয়ার নিজেই এই প্রোগ্রাম ইনস্টলেশনের অনুমতি দিয়েছেন, তিনি প্রধান তথ্য নিরাপত্তা কর্মকর্তার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি তার অধীনস্তদের বলেন, তিনি এমন একটি সিদ্ধান্তের জন্য পদত্যাগ করছেন যা গ্রাহকদের নিরাপত্তায় আঘাত করেছে। তিনি বলেছিলেন, প্রোগ্রামিংয়ের একটি ত্রুটির কারণে হ্যাকাররা জমানো সব ই-মেইলে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। জুন মাসে তিনি যোগ দেন ফেসবুকে। এ সময় তিনি এক বিবৃতি দেন। তাতে ইয়াহুর সঙ্গে কোনো সমস্যা ছিল বলে উল্লেখ করেননি তিনি।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.