‘লজিংয়ে থাকার সময় থেকেই খাদিজাকে পছন্দ করতাম। তখনও তাকে অনেকবার প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু রাজি হয়নি। বার বার প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়ায় খাদিজাকে কুপিয়েছি। ওই দিন এমসি কলেজের ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম তার সঙ্গে শেষ বোঝাপড়া করতে। কিন্তু তার বান্ধবীদের সামনেও খাদিজা প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। এ কারণে সঙ্গে থাকা চাপাতি দিয়ে কুপিয়েছি।’ সিলেটের খাদিজার ওপর হামলাকারী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা বদরুল আলম পুলিশ ও আদালতের কাছে এসব কথা জানিয়েছে। গতকাল বিকালে সিলেটের অতিরিক্ত চিফ মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে সরাবন তহুরার আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হামলার পুরো ঘটনার বিবরণ দিয়েছে সে। আদালতে ও পুলিশের কাছে বদরুল জানিয়েছে, ‘খাদিজা স্কুলে পড়ার সময় সে খাদিজাদের আউশা গ্রামের বাড়িতে লজিং থেকেছে। ওই সময় খাদিজাকে কিছু দিন পড়িয়েছে। এরপর খাদিজার প্রেমে পড়ে যায় সে। কিন্তু খাদিজা বার বারই তার প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পরবর্তীতে খাদিজা পরিবারের কাছে বিষয়টি জানিয়ে দিলে তাকে লজিং থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।’ বদরুল পুলিশকে জানায়, ‘খাদিজার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পরও সে বার বার বাইরে খাদিজার কাছে প্রেম প্রস্তাব করেছে। কিন্তু খাদিজা তার প্রেমে সাড়া দেয়নি। শেষদিন সোমবার খাদিজা যখন এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে আসে ওইদিন চাপাতি নিয়ে সে ক্যাম্পাসে যায়। খাদিজার মুখোমুখি হতে চাইলে সে এড়িয়ে যায়। এরপর রাগ করে কোমরে থাকা চাপাতি দিয়ে খাদিজাকে কোপায়।’ গতকাল বিকাল ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত আদালতে জবানবন্দি দেয়। আদালতে জবানবন্দি শেষ হওয়ার পর কোর্ট ইন্সপেক্টর মফিজুর রহমান জানিয়েছেন, আদালতের কাছে সবকিছু স্বীকার করেছে বদরুল। জেদের কারণেই সে খাদিজাকে কুপিয়েছে বলে আদালতে জানায়। তিনি বলেন, আদালত জবানবন্দি গ্রহণের পর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সিলেট মহানগর পুলিশ (দক্ষিণ)-এর এডিসি বাসুদেব বণিক বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ‘বদরুলের প্রেম ছিল একতরফা। কখনোই খাদিজা তার প্রেমে সাড়া দেয়নি। এ কারণেই বদরুল কলেজ ক্যাম্পাসে খাদিজার ওপর হামলা চালিয়েছে।’ তিনি বলেন, বদরুল পুলিশের কাছে সব স্বীকার করেছে। পাশাপাশি সে যে কুপিয়েছে সেটি তো জ্বলন্ত প্রমাণ। সুতরাং পুলিশ ন্যায় বিচারের স্বার্থে গুরুত্ব সহকারে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানান তিনি। আদালতে বদরুলের জবানবন্দি চলার সময় বাইরে ছিলেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ- কমিশনার জেদান আল মুছা। তিনি সাংবাদিকদের জানান, নগরীর আম্বরখানা থেকে আড়াইশ’ টাকা দিয়ে চাপাতি কেনে বদরুল। আর ওই চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছে খাদিজাকে। তিনি বলেন, পুলিশ রক্তমাখা চাপাতি উদ্ধার করেছে। সোমবার এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে খাদিজাকে কোপানোর পরপরই স্থানীয়রা ধাওয়া করে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক বদরুল আলমকে আটক করে। এরপর তাকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। গণধোলাইয়ে আহত হওয়ার কারণে পুলিশ বদরুলকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১ নং ওয়ার্ডে ভর্তি করেছিলো। সেখানে পুলিশি পাহারায় বদরুলের চিকিৎসা চলে। এদিকে, গতকাল সকালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বদরুলকে ছাড়পত্র দেয়। পরে তাকে পুলিশি ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হয় শাহপরান থানায়। সেখানে সিলেট মহানগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বদরুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে বদরুল পুলিশের কাছে হামলার কথা স্বীকার করে এবং প্রেমে ব্যর্থ হয়ে হামলা করেছে বলে জানায়। বিকাল ৩টায় সিলেটের শাহপরান থানা পুলিশ বদরুলকে নিয়ে আসেন সিলেট মহানগর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। ওই আদালতে বদরুলের জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। বিকাল ৫টায় জবানবন্দি গ্রহণের পর বদরুলকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কারাগারে। সিলেটের শাহপরান থানার ওসি শাহজালাল মুন্সি জানান, বদরুল আদালতে সবকিছু স্বীকার করেছে। এর আগে পুলিশের কাছেও সব স্বীকার করে।
খাদিজার অবস্থা অপরিবর্তিত, বদরুলের দ্রুত বিচার দাবি স্টাফ রিপোর্টার জানান, সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসের অবস্থা অপরিবর্তিত। তাকে নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন চিকিৎসক ও তার স্বজনরা। অস্ত্রোপচারের পর থেকে তাকে আইসিইউ’তে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। অস্ত্রোপচারের পর থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত তাকে পর্যবেক্ষণ করবেন চিকিৎসকরা। স্কয়ার হাসপাতালের অ্যাসোসিয়েট মেডিকেল ডাইরেক্টর ড. মির্জা নাজিম উদ্দিন বলেন, ৭২ ঘণ্টা পর নার্গিসের নিউরোলজিক্যাল স্ট্যাটাস অ্যাসেস করা হবে। এগুলো অ্যাসেস করার পর শরীরের আঘাতগুলোতে অর্থপেডিক চিকিৎসা দেয়া হবে। ৭২ ঘণ্টার আগে কিছুই বলা যাবে না। নার্গিসের অবস্থা সংকটাপন্ন জানিয়ে ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন বলেন, তার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। মাথায় ও হাতে অসংখ্য কোপের আঘাত রয়েছে। তার পরও আমরা আশাবাদী। মঙ্গলবার বেলা ২টা থেকে বিকাল ৫টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত নার্গিসের অস্ত্রোপচার করেন স্কয়ার হাসপাতালের তিনজন চিকিৎসক। অস্ত্রোপচারে অংশ নেয়া চিকিৎসকদের প্রধান নিউরো সার্জন ডা. এএম রেজাউস সাত্তার জানান, নার্গিসের মাথায় অসংখ্য আঘাত ছিল। তার যে অপারেশন হয়েছে, তাতে ৭২ ঘণ্টা পার হওয়ার আগে তার সম্পর্কে কিছুই বলা যাবে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে: নার্গিসকে দেখতে গতকাল বুধবার স্কয়ার হাসপাতালে যান বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ সময় তিনি খাদিজা আক্তার নার্গিসের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এই একটি ঘটনা শুধু নয়, ইতিমধ্যে বহু ঘটনা ঘটেছে। সেগুলো থেকে এটাই প্রমাণিত হয় বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। তিনি বলেন, দুঃখজনকভাবে সরকারি দলের প্রশ্রয়েই এসব ঘটনা ঘটছে। এ ঘটনা থেকে আবারও প্রমাণ হয়েছে সন্ত্রাসীরা কোথায় প্রশ্রয় পাচ্ছে। তারা কিভাবে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। বেলা ১টা ৫৮ মিনিটে তিনি স্কায়ায় হাসপাতালে প্রবেশ করেন। ২টা ২২ মিনিটে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সিলেট সরকারি কলেজের এই ছাত্রীর ওপর হামলার ঘটনাকে চরম অমানবিক ও নির্মম উল্লেখ করে তিনি বলেন, অমানবিকভাবে নরপিশাচের মতো একজন ছাত্রলীগের নেতা তাকে হত্যার উদ্দেশে ভয়াবহভাবে কুপিয়েছে। যখম করেছে। সে এখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছে।
হামলাকারীর বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত নিষ্পত্তি করা জরুরি: তার আগে দুপুর সাড়ে ১২টায় নার্গিসকে দেখতে হাসপাতালে যান মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমি মনে করি নার্গিসের ওপর হামলাকারীর বিচার বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুত করা জরুরি। সে ক্ষেত্রে আমরা আমাদের পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। এ ব্যাপারে বর্তমান সরকার অত্যন্ত সক্রিয় বলে জানান তিনি। নার্গিসের চিকিৎসার ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যেখানে যা দরকার সব সরকারিভাবে করা হবে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ভালো চিকিৎসা দেয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি ডাক্তারি পর্যায় থেকে যত ভালো চিকিৎসা দেয়া প্রয়োজন তা দেয়া হচ্ছে। বিষয়টা অত্যন্ত মর্মান্তিক ও অত্যন্ত নিষ্ঠুর উল্লেখ করে মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, আমাদের সরকার কোনোভাবেই কোনো অন্যায়কারীকে ছাড় দেবে না। বিশেষ করে যে অন্যায়কারী প্রকাশ্য দিবালোকে সবার সামনে এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাকে ছাড় দেয়ার প্রশ্নই আসে না। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার নির্দেশেই নার্গিসের খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। যে ব্যক্তি এ ধরনের ঘটনা ঘটায় সে মানুষের মধ্যে পড়ে না- মন্তব্য করে তিনি বলেন, তার মতো লোক দিয়ে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ বানাতে পারবো না। সরকার বিষয়টি সিরিয়াস ভাবে দেখছে। এই হামলা বিচারহীনতার সংস্কৃতি: খাদিজা আক্তার নার্গিসের ওপর হামলার ঘটনাকে বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফসল বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। গতকাল বুধবার সকালে স্কয়ার হাসপাতালে নার্গিসকে দেখতে গিয়ে তিনি এই মন্তব্য করেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, খাদিজার ওপর হামলার ঘটনা বিচারহীনতার সংস্কৃতির ফসল। বিভিন্ন সময় নারীর ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনাগুলোর বিচার হলে আজকের অবস্থার সৃষ্টি হতো না। তিনি হামলাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন, এ ঘটনার মূল হোতা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম যেন রাজনৈতিক পরিচয়ে বেঁচে না যায়। এই বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.