নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলের অপরাধ জগতের নিয়ন্ত্রক মীর হোসেন মীরু ওরফে ল্যাংড়া মীরুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মীরু হুইল চেয়ারে বসেই নিয়ন্ত্রণ করতো অপরাধ জগৎ। তার কর্মকাণ্ডের কেউ প্রতিবাদ করলেই কিংবা অবাধ্য হলে তার ওপর হামলা বা ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হতো। সরকারি দলের স্থানীয় শীর্ষ নেতাদের ছত্রছায়ায় কয়েক বছর ধরে ফতুল্লার পাগলা এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে মীরু ও তার বাহিনী। এতদিন অপরাধে জড়িত থাকলেও ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবশেষে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ শনিবার দুপুরে ওসি কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসী মীরুকে তার পাগলা এলাকার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে। মীরু ওই এলাকার মৃত নূর মোহাম্মদের ছেলে এবং স্থানীয় কুতুবপুর ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক। স্থানীয় এমপির যে কোনো মিছিল-মিটিংয়ে বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় মীরুকে। শুক্রবার রাতে পাগলা রেলস্টেশন এলাকায় ৪ যুবককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত ও গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় মীরুকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ জানায়, শুক্রবার রাতে পাগলা বউবাজার এলাকার ইউছুফ বেপারীর ছেলে ইমরান হোসেনের বাসায় তার বন্ধু সোহেল, মাসুম, শামীম ও মুরাদ বেড়াতে আসে। রাত সাড়ে ৮টায় তারা নিজ নিজ বাড়িতে যাওয়ার পথে পাগলা রেলস্টেশনের কাছে মীর হোসেন মীরু লোকজন নিয়ে তাদের ৪ জনের পথরোধ করে। এ সময় মীরুর নির্দেশে তার সহযোগীরা ইমরান হোসেনের ৪ বন্ধুকে মারধর এবং চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন ছুটে এলে সন্ত্রাসী শাকিল কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে পালিয়ে যায়। এরপর আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যায় স্থানীয়রা। এ ঘটনায় ইমরান হোসেন বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। ল্যাংড়া মীরুর অপরাধ সম্পর্কে এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ল্যাংড়া মীরু ফতুল্লার পাগলা এলাকায় ১৫টি হত্যাসহ ২০ মামলার আসামি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী, আততায়ীর গুলিতে নিহত তোফাজ্জল হোসেন শিকদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল। তার বিরুদ্ধেও হত্যা, বিস্ফোরক, মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে। তোফাজ্জল হোসেন সিকদারের মৃত্যুর পর পাগলা এলাকা এককভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে মীরু। ওই সময় তার প্রতিপক্ষ হয় একই এলাকার সজল বাবুর্চি। পাগলার রসুলপুর আকনপট্টি এলাকায় ২০০৯ সালে মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে সজল বাবুর্চি গ্রুপের সঙ্গে মীরু বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধ হয়। তখন পালানোর সময় কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মীরু পঙ্গু হয়ে যায়। এরপর থেকে মীরু পঙ্গু হয়ে যায়। এর কিছু দিন পর সজল বাবুর্চিও নিখোঁজ হয়ে যায়। তার কোনো সন্ধান আজও পায়নি এলাকাবাসী। ২০১২ সালের ৩রা নভেম্বর রাতে নিজ বাসা থেকে মীরু এবং তার সহযোগী ইকবালকে ৫ রাউন্ড গুলিভর্তি একটি পিস্তল ও ১৩ পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব-১০। এ ঘটনায় ফতুল্লা মডেল থানায় র্যাবের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি মামলা করা হয়। ২০১৩ সালের ১৪ই অক্টোবর প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে মীরু ও তার ক্যাডাররা ভাঙ্গাপুল এলাকায় গিয়ে জাকের পার্টির নেতা হোসেনের বাড়ির সামনে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ফাঁকা গুলি করে আতঙ্ক ছড়ায়। মীরুর মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেয়ায় ২০১৪ সালের ২৮শে এপ্রিল রাতে আবদুর রহমান ও সজল নামে দুই সহোদর ভাইকে শাহীবাজারের একটি দোকান থেকে ধরে নিয়ে কুপিয়ে সড়কের পাশে ফেলে দেয়া হয়। এ ঘটনায় মীরু ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে সহোদর ভাইয়ের মা শাহনাজ বেগম একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তুলে নিতে মীরু তার শ্যালক আরিফ, শরিফ ও রিয়াজ, রাজিবসহ ১৫-২০ জনের একটি দল নিয়ে ওই বছরের ১২ই মে রাত ১২টায় আবদুর রহমান ও সজলদের বাড়িতে গিয়ে গেট ভেঙে ফেলে এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। ওই সময় মীরুর লোকজন ওই বাড়িতে কয়েকটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ঘটনায় মীরুর বিরুদ্ধে আরো একটি মামলা হয় ফতুল্লা মডেল থানায়। গত বছরের ১০ই জুন রাতে মাদক ব্যবসা করতে বাধ্য না হওয়ায় ঘর থেকে ধরে নিয়ে মায়ের সামনে ছেলে নুরুল হককে পিটিয়ে হত্যা করে মীর হোসেন মীরু ও তার সহযোগীরা। ওই মামলায় মীরুকে প্রধান আসামি করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করা হয়। এতে মীরুসহ ৩ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পাগলা পশ্চিম রসুলপুর ভাঙ্গাপুলে গত বছরের ২৩শে জুন রাত পৌনে ১১টায় অবৈধ রেল গেট দিয়ে পার হওয়ার সময় মীরুর পরিচালিত অবৈধ হিউম্যান হলার ট্রেনের সামনে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। এ সময় হিউম্যান হলারের পাঁচ যাত্রীর মৃত্যু হয়। তখন আহত হয়েছেন আরো ১২ জন। এ ঘটনায় রেল কর্তৃপক্ষ ওই গেট বন্ধ করে দিলেও পরে মীরু তার লোকজন নিয়ে সেটি খুলে দেয়। এরপর থেকে ফের অবৈধ হিউম্যান হলার ওই স্থান দিয়ে এখনো চলাচল করছে। ওই হিউম্যান হলারের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই বলে জানান নারায়ণগঞ্জ বিএরটিএ’র দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা। ল্যাংড়া মীরু বাহিনীর অন্যতম সদস্যরা হলো- দুলালের ছেলে ভাগিনা শাকিল, রসুলপুরের আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে সুমন, শান্ত, হৃদয় আহমদ রাশেদ, আবুল পাটোয়ারীর ছেলে কালা জাহাঙ্গীর, ইউসুফের ছেলে কালা ইমরান, নুরু সর্দারের ছেলে আলমগীর, রবু মাতব্বরের ছেলে হাবিব, আবু তাহেরের ছেলে মমিন, আমিন, জামাল মৃধার ছেলে স্টিকার বাবু, মনিরের ছেলে ইকবাল, বিডিআরের ছেলে সজিব, এলাকার বাশার, রসুলপুর আটবাড়ির হাফিজ উল্লাহর ছেলে ওমর ফারুক। মীরুর সঙ্গে কয়েকটি মামলায় তারা আসামি। এ ব্যাপারে ফতুল্লা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কামাল উদ্দিন জানান, মীরুর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। শুক্রবার রাতে ৪ যুবককে কুপিয়ে আহত করার ঘটনায় আরেকটি মামলা হয়েছে। এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.