খুলনা জেলা কারাগারে কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকরের এক যুগ পর জেএমবি নেতা আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। রোববার রাত সাড়ে দশটায় ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। এর আগে গত দু’দিন ধরে খুলনা জেলা কারাগার এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় জোরদার করা হয়েছে। ১১টা ৩৫ মিনিটে লাশবাহী এ্যম্বুলেন্সে কারাগার থেকে বের হয়ে বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলায় উদয়পুরের শ্বশুরবাড়ীর উদ্ধেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় । এই সময় জেলা সুপার মো: কামরুল ইসলাম ১১টা ৫ মিনিটে প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন জেএমবি নেতা ফাসির দন্ডপ্রাপ্ত আসাদুল ইসলাম আরিফের স্ত্রী খাদিজা খাতুনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কারা কর্তৃপক্ষ তার কাছে লাশ হস্তান্তর করেছে । ফাসির দন্ডপ্রাপ্ত আরিফের নয় এবং দশ বছরের দুটি কন্যা সন্তান লাশবাহী গাড়ী সাথে ছিল। খুনি এরশাদ শিকদারের বাড়ি ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার মাদারঘোনা গ্রামের জেএমবি নেতা আসাদুলের বাড়ি বরগুনা জেলা সদরে। আসাদুল ইসলাম আরিফ ২০০৮ সাল থেকে খুলনা জেলা কারাগারে রয়েছেন। ঝালকাঠিতে দুই জ্যেষ্ঠ বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদ হত্যা মামলায় আরিফসহ ৭ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন আদালত। ইতোমধ্যে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। যাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে তারা হলো, জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, শায়খ আব্দুর রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন, খালেদ সাইফুল¬াহ ওরফে ফারুক। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ শীর্ষ এ ৬ জঙ্গির মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়। অবশিষ্ট দন্ড প্রাপ্ত জঙ্গি আসাদুল ইসলাম আরিফের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে একটি বিশ্বস্ত সূত্র। শনিবার সকাল থেকেই জেলা কারাগারে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কারাগারে যাতায়াতের রাস্তা সদর হাসপাতাল থেকে জেলখানা ঘাট পর্যস্ত ব্যারিকেড দেয়া হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ ও কারারক্ষী। আসাদুল ইসলাম আরিফ বরগুনা সদরের ইসলামপুর এলাকারহাবিবুর রহমানের ছেলে। এ ব্যাপারে একটি সূত্র জানায়, জঙ্গি নেতা আসাদুল ইসলাম আরিফ ২০০৮ সাল থেকে খুলনা জেলা কারাগারে রয়েছে। ২০০৬ সালের ২৯ মে দুই বিচারক হত্যা মামলার রায়ে ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রেজা তারিক আহম্মেদ জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই, শায়খ আব্দুর রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন, খালেদ সাইফুল¬াহ ওরফে ফারুক ও আসাদুল ইসলাম আরিফের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেন। ফাঁসি কার্যকরের সময় খুলনা জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি হিসেবে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল আলম, খুলনা সিভিল সার্জন আব্দুর রাজ্জাক, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জেল সুপার কামরুল ইসলামসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। খুলনা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. নূর-ই-আলম জানান, খুলনা জেলা কারাগারে ২০০৪ সালের কুখ্যাত খুনি এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকরের পর জঙ্গি নেতা আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের মৃত্যুদ- কার্যকর হয়েছে। ফাঁসি কার্যকরের জন্য কারাগার এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। এ ব্যাপারে খুলনা জেলা কারাগারের সুপার কামরুল ইসলাম জানান, রোববার রাতে জেএমবি নেতা আসাদুল ইসলাম আরিফের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সেজন্য জেলা কারাগারে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এদিকে ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় নিষিদ্ধঘোষিত জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গি আসাদুল ইসলামের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। চলতি বছরের ২৮শে আগস্ট রোববার সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই আদেশ দেন। মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে আরিফের করা আবেদন খারিজ করে তার মৃত্যুদন্ড বহাল রাখেন সর্বোচ্চ আদালত। ফলে আরিফের মৃত্যুদন্ড কার্যকরে কোনো বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। আর আসামি আসাদুল ইসলাম আরিফের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী এন কে সাহা। ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর সকালে ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতে যাওয়ার পথে দুই বিচারককে বহনকারী মাইক্রোবাসে বোমা হামলা করে জ্যেষ্ঠ বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদকে হত্যা করে জঙ্গিরা। জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) জঙ্গিদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১১ বছর আগে ২০০৫ সালের এই দিনে ঝালকাঠির সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ (৩৫) ও জগন্নাথ পাঁড়ে (৩৮) দুই বিচারক নিহত হন। সকাল নয়টার দিকে শহরের পূর্ব চাঁদকাঠির সরকারী বাসা থেকে কর্মস্থল জজকোর্টে যাওয়ার পথে বিচারক বহনকারী সরকারি মাইক্রোবাসে এই নৃশংস হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান বিচারক সোহেল আহম্মেদ। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু হয় জগন্নাথ পাঁড়ের। এ সময় মাইক্রোবাসটি বিধ্বস্ত হয়। আহত অবস্থায় ধরা পড়ে বোমা হামলাকারী জেএমবি সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য ইফতেখার হাসান আল মামুন। এরপর জেএমবির শীর্ষ নেতারা একে একে গ্রেপ্তার হয়। ঝালকাঠির নবনির্মিত শিল্পকলা একাডেমী ভবনকে অস্থায়ী কারাগার তৈরি করে জঙ্গিদের রাখা হয়। পরে তাদের উপস্থিতিতে জেলা জজ আদালতে চাঞ্চল্যকর এ মামলার বিচারকার্য চলে। তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রেজা তারিক আহমদ ২০০৬ সালের ২৯ মে, সাত জনকে ফাঁসির আদেশ দেন। উচ্চ আদালতে সে রায় বহালের পর ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ দেশের বিভিন্ন জেলখানায় ছয় শীর্ষ জঙ্গির মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। এরা হচ্ছে, জেএমবি প্রধান শায়খ আবদুর রহমান (ওরফে ইবনে আবদুল্লাহ, ওরফে এহসান, ওরফে মাওলানা আবদুর রহমান), সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই (ওরফে মো. সিদ্দিকুল ইসলাম প্রামানিক, ওরফে ওমর আলী, ওরফে লিটু মিয়া), সামরিক শাখা প্রধান আতাউর রহমান সানি (ওরফে তারেক সানি ইবনে আবদুল্লাহ); উত্তরাঞ্চলীয় সমন্বয়কারী (মজলিসে সুরা সদস্য) আবদুল আউয়াল (ওরফে আরাফাত, ওরফে সামাদ, ওরফে আশিক); দক্ষিণাঞ্চলীয় সমন্বয়কারী (মজলিসে সুরা সদস্য) খালেদ সাইফুল্লাহ (ওরফে মোঃ ফারুক হোসেন খান এবং বোমা হামলাকারী ইফতেখার হাসান আল মামুন। অন্য সাজাপ্রাপ্ত আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফ দীর্ঘদিন পলাতক থাকায় ওই সময় তার ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয়নি। জঙ্গিদের ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার মাত্র ১২ দিনের মাথায় ২০০৭ সালের ১১ এপ্রিল রাতে জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হন এ হত্যা মামলা পরিচালনাকারী ঝালকাঠির পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট হায়দার হোসাইন। সে মামলায় ঝালকাঠির অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক আবদুল হালিম গত ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০১৫ এ পাঁচ জেএমবি সদস্যকে ফাঁসির আদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। ফাঁসির দ্বন্ডপ্রাপ্তরা হলেন জেএমবি সদস্য আমির হোসেন, শাহাদাত হোসেন, মুরাদ হোসেন, বেল্লাল হোসেন ও সগির হোসেন। মামলার রায় ঘোষণার সময় তিনজন আসামী আদালতে উপস্থিত ছিলেন। অপর দুই আসামী বেল্লাল হোসেন ও সগির হোসেন এখনো পলাতক রয়েছে। খুলনা জেলা কারাগারের জেলার জান্নাতুল ফরহাদ বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে খুলনা কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত জেএমবি নেতা আরিফের।
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.